সুপ্রকাশ মণ্ডল
ভর্তি হয়েছিলেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে। কিন্তু নার্সিংহোম থেকে ফেরার পরে ধরা পড়ল অন্য রোগ। দেখা গেল তাঁর ডান হাতটি ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়ছে। যে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন, বর্ধমানের সেই নার্সিংহোমে বারবার যোগাযোগ করেও পাননি ন্যূনতম চিকিৎসা, কোনও সাহায্য। যে সমস্যা নিয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল নার্সিংহোমে, বছর তিনেক পরে সেই যক্ষ্মা সেরে গেলেও হাতের কর্মক্ষমতা আর ফিরে পাননি শেখ আহাদ। শেষ পর্যন্ত ক্রেতাসুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থ হন। দাবি করেছিলেন ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ। কিন্তু আদালত অভিযোগ এবং ঘটনার গভীরতা বিচার করে দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছে। আরও ৭ লক্ষ টাকা আনুষঙ্গিক ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই নার্সিংহোমকে। তা না দিলে বার্ষিক ৮ শতাংশ হারে সুদ দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, শেখ আহাদের বাড়ি বীরভূমের ইলামবাজার থানার ঘুরিশা গ্রামে। ২০২১–এর ১ মার্চ প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাঁর। স্থানীয় চিকিৎসক তাঁকে কোনও হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে ভর্তির পরামর্শ দেন। সে দিনই তিনি বর্ধমানের খোসবাগানের ‘মেডভিউ মেডিক্যাল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে নার্সিংহোমে ভর্তি হন। পরীক্ষায় ধরা পড়ে তাঁর ফুসফুসে জল জমেছে। ছোট্ট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেই জল বের করা হয়। ৩ মার্চ তাঁকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। ইঞ্জেকশন–স্যালাইন দেওয়ার জন্য তাঁর ডান হাতে চ্যানেল করা হয়েছিল। সেই সময়ে তাঁর হাতে তীব্র ব্যথা ও জ্বালা করেছিল। বাড়িতে আসার পরে সেই ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে তাঁর ডান হাতের আঙুলগুলি কালো হতে শুরু করে। পাঁচ দিন পরে ওই নার্সিংহোমে গিয়ে চিকিৎসককে তা বললেও তিনি গুরুত্ব দেননি বলে অভিযোগ। তাঁকে অন্য অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞকে দেখানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। কিছু পরীক্ষাও করতে দেওয়া হয়।
মামলায় আহাদ অভিযোগ করেন, বাড়িতে ফেরার পরে তাঁর হাতটি অবশ ও অকেজো হতে শুরু করে। নার্সিংহোমের চিকিৎসক যে পরীক্ষা করাতে দিয়েছিলেন, সেগুলির রিপোর্ট নিয়ে গেলেও নার্সিংহোম কোনও পদক্ষেপই করেনি। এর পরে বহুবার ওই সমস্যা নিয়ে মেডভিউ–তে গেলেও তাঁকে কোনও পাত্তা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। শুধুমাত্র তাঁকে যক্ষ্মার জন্য ‘ডটস’ চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে কোনও সহযোগিতা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি বীরভূম জেলা ক্রেতাসুরক্ষা আদালতে অভিযোগ করেন।
সম্প্রতি ওই আদালতের সভাপতি, বিচারক সুদীপ মজুমদার এবং সদস্য শাশ্বতী সাহা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছেন। দাবির থেকে দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ কেন, নির্দেশে তার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের একাধিক নির্দেশের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, অভিযোগকারী যা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন, পারিপার্শ্বিক বিষয় বিচার করে আদালত মনে করলে তা বাড়াতে পারে। এ ক্ষেত্রে রায়ে বলা হয়েছে, অভিযোগকারী তাঁর ডান হাতের কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। ফলে তাঁর রোজগার করার ক্ষমতাও গিয়েছে। এ ছাড়াও তাঁকে চরম মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
নির্দেশে বলা হয়েছে, নার্সিংহোম তাঁদের দায় পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, আহাদের কোনও গোপন রোগ ছিল। সেই রোগ তিনি লুকিয়েছিলেন। নার্সিংহোমের দাবি ছিল, তারা এমন কোনও চিকিৎসা করেনি যাতে আহাদের হাত অকেজো হয়ে পড়ে। কিন্তু আদালতে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ তাঁদের যুক্তির স্বপক্ষে কোনও নথিই দিতে পারেননি। তাঁকে কোন অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল, তা পুশ করার আগে পরীক্ষা করা হয়েছিল কি না, চিকিৎসার ধরন কী ছিল — তা–ও জানানো হয়নি।
নির্দেশে বলা হয়েছে, এতেই পরিষ্কার যে নার্সিংহোম কিছু গোপন করছে। এমনকী, তারা যে পদ্ধতিতে ফুসফুস থেকে জল বের করে, তাতে রোগীর বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে বলেও পরে দেখা যায়। আদালতের বক্তব্য, যদি চিকিৎসকের ভুলে ওই ঘটনা ঘটে থাকে, তা হলে তার দায় নার্সিংহোমকেই নিতে হবে। কেন নিতে হবে, তা বলতে গিয়ে ‘মনুসংহিতা’র নিদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে নির্দেশে।