এই সময়: জমানা বদলালেও পুলিশের মানসিকতার বদল হয়নি বলে হাইকোর্টে এক মামলার শুনানিতে মেনে নিলেন তৃণমূল সাংসদ আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৫ বছর আগে হুগলির জাঙ্গিপাড়ায় এক তৃণমূলকর্মীকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে খুনের অভিযোগ উঠেছিল থানার ওসি তাপসব্রতী চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে।
হাইকোর্টের নির্দেশে একাধিক দফায় সিআইডি তদন্তেও চার্জশিট পেশ হয়নি। বার বার ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে তদন্তসংস্থা অভিযুক্তদের আড়ালের চেষ্টা চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ হাইকোর্টে তুলেছেন নিহতের স্ত্রী, তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে কল্যাণের খেদোক্তি, সিনিয়র অফিসাররা ওসি–কে বাঁচাতেই মরিয়া। তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে আদালতের নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণের পরেও সিআইডি–র কোনও ভ্রুক্ষেপ হয়নি বলে তোপ দাগেন সাংসদ–আইনজীবী।
ঘটনা ২০১০-এর। রাজ্যে তখন পরিবর্তনের ঢেউ। বিভিন্ন জায়গায় স্কুল-সমবায়ের ভোটেও তৈরি হচ্ছিল প্রবল উত্তেজনা। হুগলির জাঙ্গিপাড়ায় প্রসাদপুর হাইস্কুলের কমিটি নির্বাচন ছিল ২০১০-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি। অভিযোগ, তখনকার শাসকদল সিপিএমের স্থানীয় নেতাদের কথায় ওঠাবসায় অভ্যস্ত জাঙ্গিপাড়ার পুলিশ বিরোধী দলের কর্মী–সমর্থকদের প্রতি আচমকা মারমুখী হয়ে ওঠে, গুলি চালায়। মারা যান রবিন ঘোষ নামে তৃণমূল সমর্থক যুবক। নিরস্ত্র ওই যুবককে জাঙ্গিপাড়ার ওসি তাপসব্রতী চক্রবর্তী খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন বলে অভিযোগ দায়ের হয়।
কিন্তু ওসি-কে থানা থেকে সরানো পর্যন্ত হয়নি। উত্তরপাড়ার সার্কেল ইনস্পেক্টর এএন গাঙ্গুলি ওই ওসি-কে ক্লিনচিট দিয়ে শ্রীরামপুর আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেন। নিহত রবিনের স্ত্রী লতিকা ঘোষ নারাজি পিটিশন দাখিল করেন।
এসিজেএম রতন দাসও বিস্ময় প্রকাশ করেন সিআই-এর রিপোর্টে। বিচারকের পর্যবেক্ষণ ছিল, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে দু’জন শল্য-চিকিৎসক দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়েছেন, খুব কাছ থেকে রিভলভার থেকে গুলি করা হয়েছে। অন্তত তিন জন প্রত্যক্ষদর্শীও এই মর্মে জবানবন্দি দিয়েছেন। সিআই-এর রিপোর্ট খারিজ করে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেন এসিজেএম।
তবে সিআইডি ফের ফাইনাল রিপোর্টই জমা দেয়। ক্ষুব্ধ, হতাশ লতিকা মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সহায়তায় আইনজীবী রঘুনাথ চক্রবর্তীর মাধ্যমে হাইকোর্টে সিবিআইকে তদন্তভার দেওয়ার আর্জি জানিয়ে মামলা করেন ২০১৩–য়। এরই মধ্যে সিআইডি ফের এফআরটি পেশ করে। সিআইডি-র ওই ফাইনাল রিপোর্ট গুরুতর বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ বলে পর্যবেক্ষণে বিচারপতি মহম্মদ নিজামুদ্দিন ২০১৯–এর ডিসেম্বরে খোদ সিআইডি-র ডিআইজি-কে তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু অগ্রগতি হয়নি।
গত নভেম্বরে হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন লতিকার আইনজীবী রঘুনাথ চক্রবর্তী ও নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়। তদন্তের হালে বিস্মিত বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ মামলার নথি ঘেঁটে দেখেন, প্রথম যে এফআইআর দায়ের হয়েছিল, সেটি গ্রহণের সময়ে তদনীন্তন এসডিপিও শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রিকোয়েস্টে’র উল্লেখ করেছেন। আইনজীবী কল্যাণকে এজলাসে ডেকে এই মামলায় সওয়ালের অনুরোধ করেন বিচারপতি। সেই সূত্রেই ১৬ এপ্রিল সওয়াল শুরু করেছেন কল্যাণ।
সিআইডি-র ভূমিকার প্রবল সমালোচনা করে কল্যাণের মন্তব্য, ‘সিনিয়র পুলিশ অফিসাররা অভিযুক্ত ওসি-কে বাঁচানোর শুধু চেষ্টা করে চলেছেন।’ অভিযুক্ত ওসিকে তিনি চিনতেন এবং তিনি নিজেও ওই ওসি–র ‘টার্গেট’ ছিলেন বলে অভিযোগ করেন কল্যাণ। আর এক পুলিশকর্মী সমীর সরকারের নৃশংসতা, অত্যাচারেরও উল্লেখ করেন। এপিডিআরের ভূমিকার প্রশংসা করে এই মামলায় তাঁকে সওয়ালের সুযোগ দেওয়ায় বিচারপতির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন কল্যাণ। বিশদে সওয়ালের জন্যে সময় চান। ১ মে ফের শুনানি ধার্য করেছেন বিচারপতি।