• মুর্শিদাবাদে প্রাণঘাতী হামলা চালাতে মজুত করা হয়েছিল ২০০ সিলিন্ডার ও হ্যান্ড গ্রেনেড
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২০ এপ্রিল ২০২৫
  • মুর্শিদাবাদের ঘটনায় তদন্ত প্রক্রিয়া যতই এগোচ্ছে, ততই একের পর চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে আসছে। ওয়াকফ আন্দোলনকে ইস্যু করে বড়সড় নাশকতার ছক কষেছিল জঙ্গিরা। তাদের লক্ষ্য ছিল, সামশেরগঞ্জ, সূতি ও ধুলিয়ানের বিস্তীর্ণ অংশে বড়সড় বিস্ফোরণ ঘটানো। এই অশান্তির পরিকল্পনা যে অনেক আগে থেকেই করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে নিশ্চিত গোয়েন্দারা। হিংসা ছড়ানোর উপকরণ দেখে নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দা ও প্রশাসনিক কর্তারা। আর সেজন্য দরকার ছিল একটি অজুহাতের। নতুন ‘ওয়াকফ আইন’ তাদের সেই সুযোগ করে দেয়।

    বিশেষ করে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রীতিমতো তাজ্জব বনে গিয়েছেন। দাঙ্গাকারীদের তাণ্ডবে ভাঙচুর ও বিস্ফোরণের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর পরীক্ষা করে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের অনুমান, অল্প সময়ের মধ্যে একের পর বাড়ি যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তা ভয়াবহ বিস্ফোরণেই সেটা সম্ভব। আর শক্তিশালী বোমা এই ধরনের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। কারণ বিস্ফোরণের জেরে কয়েকটি বাড়ির দেওয়ালের অংশ ভেঙে পড়েছে। ফাটল ধরেছে বাড়ির ঢালাই অংশ এমনকি ছাদেও। এমনকী কয়েকটি বাড়ির লোহার গ্রিলও ঢালাই অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে মাটিতে ঝুলছিল। গোয়েন্দারা বলছেন, লাল-সাদা মশলা মিশিয়ে তৈরি হাতবোমায় এই ধরনের বিস্ফোরণ কোনওভাবেই সম্ভব নয়। সেজন্য বাংলাদেশি জঙ্গিদের তৈরি ‘হ্যান্ড গ্রেনেডে’র প্রয়োগ নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করেছেন গোয়েন্দারা।

    ঘটনার তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, জঙ্গিরা হামলা চালানোর জন্য সামশেরগঞ্জ, সূতি ও ধুলিয়ান সহ মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু এলাকার বাড়ির ছাদে বিভিন্ন উপকরণ মজুত করে। সেই উপকরণগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল রেললাইনের পাথর, কাচের বোতল, গ্যাস সিলিন্ডার আর হ্যান্ড গ্রেনেড। যাতে দাঙ্গার সময় প্রাণঘাতী হামলা চালানো সহজ হয়।

    গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বিস্ফোরণের মাত্রা বাড়াতে মোট ২০০টি এলপিজি সিলিন্ডার জোগাড় করেছিল দুষ্কৃতীরা। আর সেই কাজ করার পিছনে ছিল ওপার বাংলা এবং এপার বাংলার সম্মিলিত জঙ্গি গোষ্ঠী। শুধু তাই নয়, গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, এই সন্ত্রাসের কাজে মজুত করা হয়েছিল প্রচুর হ্যান্ড গ্রেনেড। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সেই হ্যান্ড গ্রেনেড জেএমবি এবং অধুনা এবিটি’র জঙ্গিরা তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত।

    এই হিংসাত্মক কাজকর্মের ‘নাটের গুরু’ হিসেবে গোয়েন্দাদের নজরে সামশেরগঞ্জে ‘ডাক্তার’ বলে পরিচিত এক ব্যক্তি। ওই ব্যক্তি নিষিদ্ধ একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। উন্মত্ত জনতাকে হাতিয়ার বানিয়ে সে এই হিংসার ঘটনার মদত জুগিয়ে যাচ্ছিল বলে গোয়েন্দাদের ধারনা। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, এই ‘ডাক্তার’ই বহিরাগতদের একাংশকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিল। তার সঙ্গে মিলেই হিংসাত্মক আন্দোলনের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে সন্ত্রাসবাদীরা। হিংসার যাবতীয় নকশা চূড়ান্ত করেছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত ওই সংগঠনের সাতজন সদস্য। এই সাতজন সদস্য সম্প্রতি জামিনে জেল থেকে মুক্ত হয়েছে।

    গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, ৯ এপ্রিল মুর্শিদাবাদের ওপর দিয়ে যাওয়া জাতীয় সড়ক অবরোধের মধ্যে দিয়ে আন্দোলনের ট্রেইলার শুরু হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১১ এপ্রিল দুপুর থেকে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আক্রমণ শানানো শুরু করে হামলাকারীরা। রেল, সড়ক, সরকারি সম্পত্তি, থানা ও পুলিস কর্মীদের উপর সেই হামলার লক্ষ্য নেওয়া হয়। এমনকি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত দুই সংগঠনের লোকজন ধুলিয়ানের এক এলপিজি ডিলারকে ভয় দেখিয়ে তাঁর গোডাউন থেকে বেশ কিছু সিলিন্ডার হাতিয়ে নেয়। সেই সিলিন্ডারগুলি খুলে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয় সরকারি ভবন ও থানাগুলিতে। এমনকি প্রশাসনিক আধিকারিকদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ছক কষে জঙ্গিরা।

    সেজন্য গায়েব করা সেই সিলিন্ডারগুলি পৌঁছে দেওয়া হয় ছোট ছোট দলে ভাগ হওয়া হামলাকারীদের ডেরায়। সেই ছক অনুযায়ী এসডিপিও পদমর্যাদার এক পুলিস অফিসারকে সিলিন্ডার খুলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারারও চেষ্টা করা হয়। আগে থেকে সতর্ক হওয়ায় ওই অফিসার ও তাঁর সঙ্গী পুলিশ কর্মীরা কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচেছেন।

    জানা গিয়েছে, মুর্শিদাবাদের এই আক্রমণে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের অধিকাংশই বহিরাগত। তাদের দলে একদিকে ছিল ঝাড়খণ্ডের পাকুড় ও বিহারের কিষানগঞ্জের যুবকরা, অন্যদিকে চোরাপথে সীমান্ত পার হয়ে আসা বাংলাদেশি সন্ত্রাসবাদীরাও।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)