এই সময়, মেদিনীপুর: প্রায় ১৫ দিন পরে স্কুলে গেলেন চাকরিহারা চার শিক্ষক-শিক্ষিকা। শনিবার স্কুলে গিয়ে যেন মনটা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে গেল তাঁদের। স্কুলে তাঁরা এসেছেন শুনে স্টাফ রুমের কাছে ভিড় জমাতে শুরু করে ছাত্রছাত্রীরা। স্টাফ রুমের দিকে তাকিয়েই কেউ কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে আসে ক্লাস রুমে। কেউ আবার ছুটে চলে আসে প্রধান শিক্ষকের রুমের সামনে।
প্রধান শিক্ষক-সহ অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাতে পায়ে ধরে পড়ুয়াদের কাতর আবেদন, ‘স্যর আপনারাই পারবেন, লিপিকা ম্যাম, সাহআলম স্যর, সুপ্রিয় স্যর, অমিত স্যরদের স্কুলে ফেরাতে! না হলে আমাদের বলুন, কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে? আমরা সব কিছু করতে রাজি। শুধু আমাদের স্যর, ম্যাডামদের আমাদের স্কুলে ফিরিয়ে দিন।
আমরা জানি, আমাদের স্যর, ম্যাডামরা যোগ্য। সরকার আদালত, স্কুল সার্ভিস কমিশন, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কোথায় আমাদের যেতে হবে? আমরা সেখানেই যাব।’ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ঘিরে হাউ–মাউ করে কান্নাকাটি করতে থাকে ছাত্রছাত্রীরা। শনিবার পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর ব্লকের গোলাড় সুশীলা বিদ্যাপীঠের ঘটনা।
৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি যায় ওই স্কুলের গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও জীবন বিজ্ঞানের চার শিক্ষকের। সে দিন চোখের জল ফেলতে ফেলতে স্কুল ছেড়েছিলেন জীবন বিজ্ঞানের লিপিকা প্রহরাজ, রসায়নের শিক্ষক শেখ সাহআলম, পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অমিত বিশ্বাস, গণিতের শিক্ষক সুপ্রিয় মান্না। সে দিন স্কুলে পরীক্ষা চলছিল। ঠিক কী হয়েছে, সে দিন বুঝে উঠতে পারেনি ছাত্রছাত্রীরা। পরে তারা জানতে পারে, ওই চার শিক্ষক-শিক্ষিকা আর স্কুলে আসবেন না! ৪ এপ্রিল স্কুলে জীবন বিজ্ঞানের পরীক্ষা ছিল। স্কুলে আসেননি লিপিকা। তখনই ছাত্রছাত্রীরা জানতে পারে। মন খারাপে পরীক্ষার খাতায় তেমন কিছু উত্তরও লেখেনি অনেকে।
সুপ্রিম কোর্ট যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তার পরেই শনিবার স্কুলে গিয়ে, পরিস্থিতি দেখে তাঁদের মন আরও ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা ওই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ঘিরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সাহআলম-কে ঘিরে কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করে, ‘আপনি থাকছেন তো স্যর? আপনি স্কুলে আসবেন তো?’ ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনে মাথা নীচু করে স্যর শুধু বলেন, ‘তোমরা ভালো করে পড়াশোনা করো।’
লিপিকাকে দেখে ছাত্রছাত্রীরা ঢুকে পড়ে প্রধান শিক্ষকের ঘরে। সেখানেই বসে ছিলেন লিপিকা। তাঁকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছাত্রীরা বলে, ‘ম্যাডাম আপনি সোমবার থেকে আসবেন তো? কথা দিন। আমরা সব পড়া করে আসব। যা বলবেন সব শুনব। আপনি ক্লাস টিচার। ক্লাসে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না!’ চোখের কোন চিক চিক করতে থাকে প্রধান শিক্ষক সুরেশ পড়িয়া–সহ ঘরে থাকা অন্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদেরও।
লিপিকা বলেন, ‘ওদের সরল মনের প্রশ্নগুলোর কী উত্তর দেব। এ দিন স্কুলে গিয়ে আরও বেশি মন খারাপ হয়ে গেল। আমরা কী করে ওদের বোঝাব যে আমরা যোগ্য। স্কুল সার্ভিস কমিশনতো এখনও যোগ্য-অযোগ্য তালিকা প্রকাশ করেনি। অযোগ্যদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেনি।’ প্রধান শিক্ষক সুরেশের কথায়, ‘প্রতিদিন ওই ছাত্রছাত্রীরা এসে আমাকে ঘিরে ধরছে। বলছে, আপনিই পারবেন ওই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ফিরিয়ে আনতে। আপনি ফিরিয়ে দিন। আমি ওদের বুঝিয়ে উঠতে পারিনি যে আমি কত অসহায়।’