• সমরেশ বসুর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে ডিজিটাল আর্কাইভের উদ্যোগ
    আনন্দবাজার | ২০ এপ্রিল ২০২৫
  • মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাতে লেখা পত্রিকা ‘বীণা’ প্রকাশ করেছিলেন বাংলা সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র সমরেশ বসু। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ৯০ পাতার সেই পত্রিকায় নিজের হাতে এঁকেওছিলেন কিশোর সমরেশ। পাঁচটি সংস্করণের সেই পত্রিকার মধ্যে মাত্র একটিই সাহিত্যিকের পারিবারিক সংগ্রহে রয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সাহিত্যিকের লেখা বহু পাণ্ডুলিপির খসড়া, চিঠি, নোট্‌স, স্মারক, দুষ্প্রাপ্য ছবি, রাজবন্দি অবস্থায় প্রেসিডেন্সি জেল থেকে স্ত্রীকে লেখা চিঠি। সেই সব স্মৃতিকেই সংরক্ষণ করে রাখতে এবং আগামী প্রজন্মের কাছে সাহিত্যিককে পৌঁছে দিতে শুরু হচ্ছে সমরেশ বসু ডিজিটাল আর্কাইভ। তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত অনেক কিছুই ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

    সাহিত্যিকের কনিষ্ঠা কন্যা মৌসুমি সমাদ্দারের ছেলে প্রাচেতস সমাদ্দারের হাত ধরেই পূর্ণতা পাচ্ছে এই আর্কাইভ। মৌসুমি এবং লেখকের কনিষ্ঠ পুত্র উদিত বসু, লেখকের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা ছবি, চিঠি, লেখালিখির কাগজ ইত্যাদি নিয়েই পথ চলা শুরু করছে এই আর্কাইভ। আগামী ২৬ এপ্রিল উদ্বোধন হতে চলেছে www.samareshbasu.com ওয়েবসাইটের। এর মাধ্যমেই ওই আর্কাইভের নাগাল পেতে পারবেন যে কেউ। এমনকি, কোনও পাঠক বা প্রকাশকের কাছে লেখকের স্মৃতিবিজড়িত কোনও কিছু থাকলে তা-ও ভবিষ্যতে আর্কাইভে স্থান পেতে পারে।

    আর্কাইভ করার ভাবনা এল কী ভাবে? প্রাচেতসের কথায়, ‘‘আমার ৪-৫ বছর বয়সেই দাদু মারা যান। তাই বড় হয়ে তাঁর লেখার মাধ্যমেই দাদুকে চিনতে শুরু করি। তাঁর সাহিত্য এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে যে গভীর যোগাযোগ রয়েছে, তখনই তা আবিষ্কার করতে শুরু করি। ‘গঙ্গা’ লেখার সময়ে তাঁর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল, ‘বিবর’ লেখার সময়ে তাঁর পারিবারিক জীবন কোন খাতে বইছে — সে সবই বুঝতে শুরু করি। তাই বছর দেড়েক আগে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনের সময়ে মনে হল, এই যোগাযোগকে সংরক্ষণের একটা মাধ্যম প্রয়োজন।’’

    প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বাংলার লেখকদের কাজ নিয়ে আর্কাইভ থাকলেও ব্যক্তিগত পরিসরে এমন উদ্যোগ এই প্রথম। এই উদ্যোগে প্রাচেতস পাশে পেয়েছেন আর্কাইভার এবং শিল্প ইতিহাসবিদ সম্পূর্ণা চক্রবর্তীকে। তিনি বলছেন, ‘‘সাহিত্যিক সমরেশের লেখা আজও প্রাসঙ্গিক। অথচ আজকের নবীন প্রজন্ম তো বই, বাংলা সাহিত্য তেমন পড়ে না। তাই তাদের কাছে সাহিত্যিক ও তাঁর লেখা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হতে পারে এই আর্কাইভ।’’ বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাতেও লেখা থাকবে এই আর্কাইভে।

    শুধু নথি বা তথ্যই নয়, এই ডিজিটাল আর্কাইভে থাকছে সাহিত্যিকের জীবনের কালানুক্রমিক অংশও। থাকছে ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাস লেখার শুরুতে হাতে লেখা কয়েক পাতা নোটস। পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে সেই দলের সদস্য হিসাবে জেলে যেতে হয়েছিল লেখককে। সেই সময়ে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে প্রথম স্ত্রী গৌরী বসুকে লেখা তাঁর চিঠির দেখা মিলবে এই আর্কাইভের দুনিয়ায়। প্রাচেতস বলছেন, ‘‘সে সময়ে দাদু জেলে যাওয়ায় চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েছিলেন দিদা। উপায় না দেখে গিয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে। শুনেছি, যত দিন দাদু জেল থেকে ছাড়া না পাচ্ছেন, তত দিন তাঁর পরিবারের জন্য ভাতার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।’’

    লেখকের এই সব স্মৃতিকে আলমারিতে বাক্সবন্দি করে রাখা নয়, বরং মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই আর্কাইভের কথা ভেবেছে তাঁর পরিবার। সম্পূর্ণার কথায়, ‘‘ইতিহাসকে কী ভাবে যত্ন করতে হয়, সেই ধারণা ও সচেতনতাকে ছড়িয়ে দিতেই এই উদ্যোগ। সেই সঙ্গে যে কোনও পারিবারিক সংগ্রহকে কী ভাবে সংরক্ষণ করা যাবে, সেই সংক্রান্ত নির্দেশিকাও দেওয়া থাকবে এই ওয়েবসাইটে।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)