• সিনেমার টিকিট জমিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে কলকাতার স্কুল টিচার
    এই সময় | ২১ এপ্রিল ২০২৫
  • প্রশান্ত ঘোষ

    সিধুকে ম্যাটিনি শো–এর দুটো টিকিট কাটতে দিয়েছিলেন তার কাকিমা। সে টিকিট শেষ পর্যন্ত আর কাকিমার হাতে পৌঁছয়নি। টিকিট কাটার নাম করে সিধু সটান চলে গিয়েছিল প্রেমিকার কাছে। পুকুরপাড়ে রচিত হয় বাংলা ছায়াছবির ইতিহাসের ল্যান্ডমার্ক সংলাপ — ‘শোনো... তুমি আমাকে বলো উত্তমকুমার।’ এ দিকে টিকিট না-পেয়ে খোঁজাখুঁজি করতে করতে কাকিমা অকুস্থলে পৌঁছতেই পুকুরে ঝাঁপ সিধুর।

    সেল্যুলয়েডের সিধু যে কাজ করেনি, বাস্তবের দেবাঞ্জন সে কাজটি করেই ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ নিজের নাম তুলে ফেলেছেন। ‘বসন্ত বিলাপ’-এর সিধু সিনেমার টিকিট কাটেনি, আর অনলাইনের এই রমরমার যুগেও কলকাতার বছর ছত্রিশের দেবাঞ্জন শীল টিকিট কেটেই চলেছেন।

    আর সেটা করতে করতেই গিনেস-এর হিসেবে তাঁর সংগ্রহ ১৯৭টি সিনেমা হলের ১,০৩৪টি ভিন্ন শো ও ভিন্ন ছবির টিকিটের কাউন্টারপার্ট! তবে এই সংখ্যা আরও কিছুটা বেশি হতে পারে। কারণ ‘গিনেস’-এ আবেদন করার পরেও দেবাঞ্জন কয়েকটি সিনেমা দেখেছেন। গত রবিবারই ‘মিনার’ সিনেমা হলে দেখে এসেছেন ‘পুরাতন’। সেই টিকিটেরও কাউন্টারপার্ট দেবাঞ্জন রেখে দিয়েছেন তাঁর সংগ্রহে।

    কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কাগজের টিকিট কেটে সিনেমা দেখার যুগ অস্তমিত। সে ছিল ফিল্ম নিয়ে উন্মাদনার এক অন্য সময়। উত্তমকুমার, দিলীপ কুমার, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন — সুপারস্টারদের সুপারহিট ছবি লেগেছে হলে! ছোট্ট কাউন্টারের সামনে ঠাসাঠাসি ভিড়। অনলাইন তখন কোথায়! সেখানে লাইন বলেই কিছু নেই। ঘুপচি কাউন্টার খুলতেই ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে হাত ঢোকানোর জন্য প্রায় মারামারির পরিস্থিতি।

    তার মধ্যেই কানের কাছে ব্ল্যাকারদের গুনগুনিয়ে বলে চলা, ‘আড়াইয়ের টিকিট দশে, আড়াইয়ের টিকিট দশে...।’ সেই যুদ্ধে বাকিদের হারিয়ে হাতের মুঠোয় দুমড়ে–মুচড়ে প্রায় কাগজের তাল পাকিয়ে যাওয়া টিকিট নিয়ে মুখে বিশ্বজয়ের হাসি আর গলদঘর্ম শরীরে সিনেমা হলে ঢোকার নস্ট্যালজিক ফ্রেমে এখন সময়ের সিপিয়া টোন। সামনের সারিতে বসা দর্শকের কাঁধের উপরে পা তুলে ‘বচনা অ্যায় হাসিনো’র তালে তালে নাচ আর শিস দেওয়া, খুচরো পয়সা ছোড়া — অনলাইনে টিকিট কেটে মাল্টিপ্লেক্সে যাওয়া প্রজন্মের কাছে এ সব রূপকথার মতো। টিকিট কাউন্টার এখন নেই এমন নয়, তবে সেই রঙিন কাগজের টুকরো ঘিরে পাগলামোর দিন সিনেমা হল চত্বর ছেড়ে চলে গিয়েছে বহু দূরে। সেই স্মৃতিগুলিই বাঁচিয়ে রাখতে চান দেবাঞ্জন।

    ছোট থেকেই সিনেমার পোকা। দেবাঞ্জন জানালেন, ২০০৩-এ অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে লেক টাউনের জয়া সিনেমা হলে গিয়েছিলেন ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ দেখতে। সেই প্রথম তাঁর হাতে টিকিটের কাউন্টার পার্ট আসে, যা বইয়ের পাতায় লুকিয়ে রাখা ছিল দীর্ঘদিন। এর পরে ডাকটিকিট বা রেল-বাসের টিকিটের মতোই সিনেমার টিকিট জমানোর শখ তৈরি হয়। একে একে রক্সি, প্যারাডাইস, এলিট, ছবিঘর, মিনার, বিজলি — কলকাতার সর্বত্র ছুটে গিয়েছেন সিনেমা দেখতে।

    সিনেমা ভালো না খারাপ, অনেক সময়ে সে হিসেব করেননি। লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব টিকিট জমানোর। শুধু কলকাতা নয়, বারুইপুর থেকে বারাসত পেরিয়ে মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম এমনকী উত্তরবঙ্গেও পাড়ি দিয়েছেন দেবাঞ্জন। এ ভাবেই ১৯৭টি হলের বিভিন্ন ছবির ১,০৩৪টি ভিন্ন শো-এর টিকিট সংগ্রহ করে পাঠান ‘গিনেস’ কর্তৃপক্ষকে। বেসরকারি স্কুলের বায়োলজি শিক্ষকের আবেদন খতিয়ে দেখেন তাঁরা। সম্প্রতি বাগুইআটির জ্যাংড়ায় দেবাঞ্জনের বাড়িতে পৌঁছেছে গিনেসের মেডেল ও সার্টিফিকেট।

    দেবাঞ্জনের সংগ্রহে শুধুমাত্র জয়া সিনেমা হলেরই ১৫৪টি টিকিট রয়েছে। কাঠের চেয়ারের সোঁদা গন্ধের টানে কয়েক দিন আগে লাউহাটির রাজেন্দ্র সিনেমা হলে গিয়েছিলেন। সেখানে মাত্র তিন জন দর্শকের জন্য শো চালিয়েছিলেন হল কর্তৃপক্ষ। রেখে দিয়েছেন সেই টিকিট। দেবাঞ্জনের কথায়, ‘একসময়ে লাল, হলুদ, নীল খসখসে কম দামি কাগজে ব্যালকনি বা রেয়ার স্টলের টিকিট মিলত। পরে রেলওয়ের মতো টিকিট এল। কিছু দিন আগেও মাল্টিপ্লেক্সে সরু লম্বা কাগজে কম্পিউটার প্রিন্টেড টিকিট দেওয়া হতো। এখন তো অধিকাংশ জায়গায় কিউআর কোডে ডিজিটাল টিকিট। আগামী দিনে এই কাগজের টিকিট থাকবে না।’

    দেবাঞ্জনের আক্ষেপ, ‘কাগজের টিকিট বিক্রি করা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে একে। এগুলোও হয়তো বেঁচে থাকবে এই টিকিটের মধ্যেই।’ বন্ধ হয়ে যাওয়া হাতিবাগানের রাধা, মছলন্দপুরের পূর্বাশা, বরাহনগরের অনন্যা, দমদমের নরেন্দ্র, লীলা, চেতনা, নেত্রর মতো হলের টিকিটের কাউন্টারপার্ট রয়েছে দেবাঞ্জনের সংগ্রহে।

    দেখতে দেখতে ২২ বছর হয়ে গেল টিকিটের কাউন্টারপার্ট সংগ্রহের। ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা — সব দামের টিকিট রয়েছে দেবাঞ্জনের কাছে। ২০২৩-এ ‘ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস’-এ নাম উঠেছিল তাঁর। এর পরে গিনেস। পরিবার থেকে বন্ধুবান্ধব, সকলেই তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। ‘গিনেস’-এর ওয়েবসাইটে জ্বলজ্বল করছে দেবাঞ্জনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা — ভাইয়ের সঙ্গে ‘ওম শান্তি ওম’ দেখতে যাওয়া।

    সিধু টিকিট কাটেনি। তার বন্ধু ললিত আবার সিনেমার দুটো টিকিট কেটে ফেঁসে গিয়েছিল। ‘বসন্ত বিলাপ’-এর দুই বন্ধুর মতো জীবনের কত রঙিন অভিজ্ঞতাই না লুকিয়ে থাকে সিনেমার টিকিটে। দেবাঞ্জনের সংগ্রহ যেন সেই নস্ট্যালজিয়াকেই আগলে রেখেছে সযত্নে।

  • Link to this news (এই সময়)