এই সময়: কোচবিহারের দিনহাটার বাসিন্দা দেবু রায় এলাকায় মেধাবী বলেই পরিচিত। ২০১৬–র এসএসসি পরীক্ষায় বসে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কোনও ভুল না করেই চাকরি চলে গিয়েছে বলে তাঁর দাবি। বই–খাতা, স্কুল আর বাড়ির বাইরে এতদিন খুব একটা বেরোতেন না দেবু। এখন চাকরি ফেরানোর দাবিতে তাঁকেই নামতে হয়েছে রাস্তায়।
সে কারণে পুলিশ তাঁর বাড়িতে হাজির হয় বলে দেবুর অভিযোগ। কেন তিনি পথে নেমে প্রতিবাদ করছেন, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে দিন তিনেক আগে বাড়িতে এসেছিল পুলিশ। তাঁর নাম, বাবার নাম, কোথায় স্কুল, এ সবের পাশাপাশি তিনি আন্দোলনে যাচ্ছেন কি না, আর কারা যাচ্ছেন, তা নিয়েও চলে বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ।
দেবুর কথায়, ‘আজ পর্যন্ত তো বাড়িতে কোনও কারণে পুলিশ আসেনি। এ সবের অভিজ্ঞতাও নেই। আমাদের এখানে আটটা–ন’টা মানে অনেক রাত। সেই সময়েই বাড়ি এসে পুলিশ এতকিছু খোঁজ নেওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।’
দিন দুয়েক আগের কথা। সন্দেশখালি থানা থেকে ফোন পান আরও এক চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষক শুভজিৎ দাস। দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি স্কুলে নবম–দশমের শিক্ষক ছিলেন তিনি। বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে। শুভজিতের অভিযোগ, তিনি আন্দোলনে যাবেন কি না, আর কারা সেখানে যেতে পারেন, আন্দোলনের পদ্ধতি কী, ফোনে বারবার এ সব জানতে চাইছিল পুলিশ।
শুভজিৎ বলছেন, ‘আমার বাড়ি সন্দেশখালি থানার পাশেই। বেশিরভাগ সময়ে কলকাতার ওয়াই চ্যানেলে ধর্নায় থাকছি। সেই সূত্রে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তাও হচ্ছে। আলাদা করে আবার সন্দেশখালি থানা থেকে ফোন এল কেন, সেটা বোধগম্য হচ্ছিল না। ওদের কাছে লিখিত অর্ডার আছে কি না, তা দেখতে চেয়ে জোরাজুরি করায় ওরা ফোন কেটে দেয়।’
এমন আরও উদাহরণ আছে বলে জানাচ্ছেন চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষকরা। তাঁদের অভিযোগ, অনেকের বাড়িতেই পুলিশ গিয়ে উঁকি মারছে বা ফোনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। একে ‘পুলিশি হেনস্থা’ বলেই চিহ্নিত করছেন তাঁরা। চাকরিহারা মঞ্চের নেতা মেহবুব মণ্ডল শনিবার অনেক রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি লাইভ করে বলেন, ‘অনেক জায়গা থেকেই খবর পাচ্ছি যে, পুলিশ বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। ফোন করে উক্ত্যক্ত করছে। আপনারা পুলিশের ভয় করবেন না। চোখ তুলে প্রশ্ন করুন। কী হারাবেন? আর কী হারানোর আছে আপনাদের।’ চাকরিহারাদের অভিযোগ, ভয় দেখাতে, আন্দোলনের ঝাঁজ কমাতেই আসরে নেমেছে পুলিশ।
অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় রায়ের পরে আপাতত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যেতে বাধা নেই ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের। যদিও শনিবার দেখা যায় যে, অধিকাংশ শিক্ষকই স্কুলে গরহাজির ছিলেন। আজ, সোমবার এসএসসি ভবন ও কাল, মঙ্গলবার রাজভবন অভিযান রয়েছে এঁদের। গোটা রাজ্য থেকেই বহু চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষিকারই তাতে সামিল হওয়ার কথা। কাজেই, আজ–কালও এই শিক্ষকরা স্কুলে যাবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
সূত্রের খবর, এমন অবস্থায় কারা স্কুলে কাজে যোগ দিচ্ছেন আর কারা দিচ্ছেন না, তার উপরে নজর রাখছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও শিক্ষা দপ্তর। যাঁরা কাজে যোগ দিচ্ছেন না, তাঁরা ‘টেন্টেড’ বা ‘অযোগ্য’ বলে স্কুল এড়িয়ে যাচ্ছেন কি না, তারও উত্তর পেতে চাইছেন শিক্ষাকর্তারা। চাকরিহারাদের অভিযোগ, পুলিশ ও এই নজরদারির মাধ্যমে আসলে চাপের কৌশল নিয়েছে সরকার। যদিও দপ্তর বা পর্ষদের তরফে কোনও কথা বলা হয়নি। আর রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানান, এমনটা যে করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে তাঁর কিছু জানা নেই।
অথচ সপ্তাহ খানেক আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী থানা এলাকার বাসিন্দা তথা চাকরিহারা শিক্ষক দিবাকর সর্দারের বাড়িতেও সিভিল ড্রেসে যায় পুলিশ। তাঁর কাছে গিয়েও একই ভাবে খোঁজখবর করা হয়। কারণ জানতে চাইলে বলা হয়, ‘উপরমহলের নির্দেশ’। পূর্ব বর্ধমানের চাকরিহারা শিক্ষিকা কামরুন নাহার খাতুনের আবার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়।
তিনি বলছেন, ‘আমার এবং আমার দাদার চাকরি একসঙ্গে চলে গিয়েছে। এলাকার এক তৃণমূল নেতাকে ফোন করে পুলিশ আমাদের বিষয়ে খোঁজখবর শুরু করে। ওই নেতা আমাদের বাড়ি এসে নিজের ফোন থেকেই পুলিশের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করেন। পুলিশ জানায়, নেতার ফোনে বেশ কিছু প্রশ্ন পাঠানো হয়েছে। সেগুলির উত্তর যেন দিই।’
কেমন প্রশ্ন? সেখানে ব্যক্তিগত পরিচয়ের পাশাপাশি ২০১৬–র এসএসসি পরীক্ষার রোল নম্বর, এলাকায় আর কারা চাকরি হারিয়েছেন তাঁর নাম ও ফোন নম্বর চাওয়া হয়েছে। লিখিত অর্ডার দেখতে চাইলে অবশ্য পুলিশ আর কোনও প্রশ্ন করেনি। একই অভিজ্ঞতা উত্তর ২৪ পরগনার অন্বেষা খাতুনের। তাঁর স্বামীর মোবাইলে বারবার ফোন করে অন্বেষার গতিবিধি পুলিশ জানতে চাইছে বলে অভিযোগ।
তাঁর কথায়, ‘পুলিশ বারবার স্বামীকে ফোন করায় স্বাভাবিক ভাবেই উনি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। পুলিশের উদ্দেশ্য তো বোঝাই যাচ্ছে।’ কামরুনের সংযোজন, ‘যারা চোর, তাদের না ধরে পুলিশ এখন যোগ্যদের টার্গেট করছে!’