বিশ্বরূপ মজুমদার, চোপড়া
হালফিলের রাজনীতিক বা তাঁদের পরিবারের ছবির পাশে এ ছবি একেবারেই বেমানান। বর্তমান তো বটেই, অনেক প্রাক্তন সাংসদ বা বিধায়কদের জীবনযাত্রা দেখলে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। এই চেনা পৃথিবীর বাইরে আরও একটি পৃথিবী রয়ে গিয়েছে। সেখানে এখনও মরচে ধরা সততাই আঁকড়ে ধরে থাকেন কয়েকজন। যেমন চোপড়ার প্রয়াত বিধায়ক বাচ্চা মুন্সি। দু’–দুবারের বিধায়ক। তা–ও আবার তৎকালীন শাসকদলের। অথচ, আখের গোছানোর কোনও কাজই তিনি করেননি।
তাই নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছেন তাঁর পরিবার। অসুস্থ হয়ে উন্নত চিকিৎসা না পেয়ে বাচ্চার বড় ছেলে কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। বাকি দুই ছেলে চা বাগানের শ্রমিক। ইতিমধ্যেই মেজো ছেলের বাগানে তালা পড়ে গিয়েছে। ছোট ছেলের বাগানও বন্ধের মুখে। শাসকদলের বিধায়ক হওয়ার সুবাদে ছেলেদের ভবিষ্যৎ কী তিনি গড়ে দিতে পারতেন না? না, তিনি তা করেননি। আর এর জন্য বাবার প্রতি বিন্দুমাত্র রাগ বা ক্ষোভ নেই ছেলেদের। উল্টে দারিদ্রের মধ্যেও বাবার সততা তাঁদের লড়াই করার রসদ জোগায়।
১৯৭৭ সালে চোপড়ায় সিপিএমের বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন বাচ্চা মুন্সি। বিধায়ক হওয়ার আগে তিনি লোকের বাড়ির ঘর ছাউনির কাজ করতেন। কিন্তু বিধায়ক হওয়ার পর ছাউনি দেওয়ার কাজ না করলেও তাঁর জীবনযাপন ছিল খুব সাদামাটা। বিধায়ক হওয়ার সুবাদে ট্রেনে এসি কামরায় যাওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি স্লিপার ক্লাসেই যাতায়াত করতেন। অনেক সময়ে বাসে করেও চলে যেতেন। কলকাতায় এমএলএ হস্টেলে গিয়ে খাটের গদি মেঝেতে নামিয়ে রেখে ঘুমোতেন। এমএলএদের জন্য বিধানসভায় আসতে সরকারি বাসের ব্যবস্থা থাকলেও তিনি হস্টেল থেকে হেঁটে বিধানসভায় চলে যেতেন। ১৯৮২ সালেও তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হন।
মারা যাওয়ার আগে তার ছেলেদের সাধারণভাবে থাকার মন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন এই বাম বিধায়ক। তাই এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পরও আজও তাঁর ছেলেরা খুব সাধারণ জীবনযাপন করছেন। বাচ্চার মেজ ছেলে সামসের আলি ও ছোট ছেলে খাজিমুল ইসলাম দু’জনেই বাগান শ্রমিক। এর মধ্যে সামসের ফ্যাক্টরি বন্ধ। খাজিমুলের ফ্যাক্টরিও বন্ধের মুখে। এখন চাষবাস করে কোনও ভাবে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে দিন কাটছে তাঁদের। সামসের বলেন, ‘বাবাকে দেখেছি কী ভাবে সৎ থেকে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। সে সময়ে বাবা চাইলে আমাদের চাকরি দিতে পারতেন। কিন্তু তা উনি করেননি। আজ অর্থ কষ্টে জীবন কাটলেও বুক ঠুকে বলতে পারি আমি বাচ্চা মুন্সির ছেলে।’
সিটুর জেলা সম্পাদক স্বপন গুহ নিয়োগী বলেন, ‘যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয় বাচ্চা মুন্সি কেমন? তাহলে আমি বলব, একজন প্রকৃত কমিউনিস্ট যেমন। তাঁর ছেলেরা কষ্টে থাকলেও অসৎ পথে যায়নি। এটাই তো প্রকৃত বামপন্থীর উদাহরণ।’ প্রদেশ কংগ্রেস সদস্য অশোক রায় বলেন, ‘বাচ্চা মুন্সির ছেলেদের জমি–জায়গা তেমন কিছুই নেই। আজকালকার দিনের নেতাদের ছেলেদের মতো এলাহি ব্যাপার ওঁদের নেই। এই যুগে থেকেও ওঁরা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।’