এই সময়: প্রতিশ্রুতি, দাবি আদায়ে মিছিল, দিনভর অপেক্ষা পরেও প্রকাশিত হলো না ‘যোগ্য–অযোগ্য’র তালিকা। সুপ্রিম–রায়ে তথাকথিত ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের দাবি শেষমেশ মিটল না। দিনভর প্রত্যাশা সন্ধের পরে চেহারা নিল ক্ষোভের। আর এসএসসি–র প্রায় ২৬ হাজার নিয়োগ বাতিল সংক্রান্ত মামলার গোড়া থেকেই যে প্রশ্নটা উঠছিল— কে ‘যোগ্য’, কে–ই বা ‘অযোগ্য’, তার জবাব মিলল না সোমবার রাত পর্যন্ত। বরং মাঝরাতে এসএসসি–র তরফে একটি বিবৃতিতে নতুন করে বিভ্রান্তি বাড়ল।
এ দিন সকালে তথাকথিত ‘যোগ্য’ চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীরা মূলত এই তালিকা প্রকাশ–সহ একগুচ্ছ দাবিতে সল্টলেকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) অফিস অভিযান করেন। সেই অভিযান শেষে ১৩ জন শিক্ষক–শিক্ষিকার একটি প্রতিনিধি দল দেখা করে এসএসসি–র চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদারের সঙ্গে। আর বাকিরা এসএসসি অফিসের বাইরেই অপেক্ষা করতে থাকেন।
কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টার বৈঠক রইল নিষ্ফলা। ‘যোগ্য শিক্ষক–শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ’র তরফে মেহবুব মণ্ডল ও চিন্ময় মণ্ডলরা বলেন, ‘যতক্ষণ না পর্যন্ত এসএসসি যোগ্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করছে, ততক্ষণ এসএসসি অফিস ঘেরাও করে রাখা হবে। ঘেরাও করে রাখা হবে এসএসসি চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদারকেও।’ রাত সওয়া ৮টা নাগাদ এই প্রতিনিধিরা বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে জানান, চেয়ারম্যান যে তালিকা প্রকাশ করতে চাইছিলেন, সেটা বিভাজনমূলক তালিকা।
এই তালিকা তাঁরা মানবেন না। তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। এটা তাঁরা চলতে দেবেন না। এরপরে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, লাগাতার এসএসসি অফিসের সামনে ধর্না–অবস্থান কর্মসূচি চলবে।
এ দিন রাতে এসএসসি–র চেয়ারম্যান একটি বিবৃতিতে জানান, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনেই চলবেন। এবং শিক্ষা দপ্তরের তরফ থেকে তাঁদের জানানো হয়েছে, যে শিক্ষকরা ক্লাস করাচ্ছেন, তাঁদের বেতন দেওয়া হবে। তবে এই বিবৃতিতে প্রশ্ন উঠেছে— যদি এসএসসি সুপ্রিম–রায় মেনেই নেয়, তা হলে কি আর রিভিউ পিটিশনের ‘আশ্বাসে’র কী অর্থ রইল? আর সুপ্রিম কোর্ট তো বলেছিল, ‘টেন্টেড’ নন, এমন শিক্ষকরা আপাতত ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যেতে পারবেন। তা হলে যাঁরা ক্লাস করাচ্ছেন, শুধু তাঁরাই বেতন পাবেন কেন? কলকাতা এবং জেলায় জেলায় তো বেশির ভাগ ‘যোগ্য’ চাকরিহারাই তো আন্দোলনে সামিল হয়েছেন।
আবার যেহেতু এসএসসি ‘অযোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর কোনও তালিকা এখনও বের করেনি, তাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকরাও ধন্দে, এ মাসের স্যালারির রিক্যুইজ়িশন কাদের জন্য পাঠানো হবে, আর কাদের জন্য হবে না। রাতে সংবাদমাধ্যমকে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, ‘আমরা আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেই বলছি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো আমরা পদক্ষেপ করব। আর যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষকরা বেতন পাবেন। বেতন এসএসসি দেয় না, দেয় রাজ্য সরকার।’
কিন্তু কোথায় আটকে গেল এ দিনের আলোচনা?
যে সব প্রতিনিধিরা কমিশনের অফিসে বৈঠকে গিয়েছিলেন, তাঁদের একজন ফোনে বাইরে জমায়েত হওয়া অন্য চাকরিহারাদের জানান— এসএসসি তাঁদের জানিয়েছে, ২০১৬–এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে নবম–দশমে শিক্ষক পদে ১৩ দফা কাউন্সেলিং হয়েছিল। তার মধ্যে তৃতীয় কাউন্সেলিং পর্যন্ত অংশ নেওয়া সব চাকরিপ্রার্থীর তালিকা এসএসসি প্রকাশ করতে পারে। বাকিটা করা হবে না। এসএসসি তাঁদের যুক্তি দেয়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, বাকি পর্যায়ের কাউন্সেলিংগুলি প্যানেল প্রকাশের এক বছর পরে হয়েছিল।
আবার উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মোট সাত দফা কাউন্সেলিং হলেও দ্বিতীয় দফা পর্যন্ত তালিকা প্রকাশ করা যাবে। বাকি কাউন্সেলিং হয়েছে প্যানেল প্রকাশের এক বছর পরে, যা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ‘মেয়াদ উত্তীর্ণ’। চাকরিহারারা দাবি করেন, মাধ্যমিক স্তরে অন্তত সপ্তম দফার কাউন্সেলিং পর্যন্ত তালিকা প্রকাশ করতে হবে। এ নিয়েই চলতে থাকে টানাপড়েন। ততক্ষণে বাইরে প্রতীক্ষারত অন্য চাকরিহারাদের মধ্যেও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
তাঁদের অভিযোগ, ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের মধ্যেও এসএসসি ও সরকার বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে। পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের দাবিতে সন্ধে সওয়া ছ’টা থেকেই এসএসসি ভবনের বাইরে মোতায়েন বিশাল সংখ্যক পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায় চাকরিহারাদের। ঘণ্টা খানেক বাদে পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এলেও রাত সওয়া ৮টা নাগাদ প্রতিনিধি দল বাইরে বেরিয়ে এসে এসএসসি অফিস লাগাতার ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এরপরে চাকরিহারারা এসএসসি ভবনের সামনেই রাস্তাজুড়ে বসে পড়েন।
এসএসসি অফিসের দু’টি গেট, সামনের রাস্তা রাত পর্যন্ত পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এমনকী এসএসসি–র চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার সাংবাদিক বৈঠক করতে চাইলেও শেষমেশ তা ভেস্তে যায়। চাকরিহারারা দাবি তুলতে থাকেন, তাঁদের সবাইকেই ভিতরে ঢুকতে দিতে হবে। ‘এসএসসি অফিস ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’–এর মতো স্লোগানও ওঠে। শিক্ষামন্ত্রী ও এসএসসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিও তোলেন আন্দোলনকারীরা।
মেহবুবদের দাবি, ‘এসএসসি চেয়ারম্যান আমাদের জানিয়েছেন, মাধ্যমিক স্তরে তৃতীয় কাউন্সেলিংয়ের পরে অন্যান্য দফার কাউন্সেলিংয়ের তালিকা প্রকাশ করা যাবে না। কারণ, তাতে তৃতীয় দফার পরে অন্য শিক্ষকদের সবার বেতনই বন্ধ হয়ে যাবে। কীসের ভিত্তিতে এসএসসি বলছে, যে থার্ড কাউন্সেলিং পর্যন্ত বৈধ? অথচ ওরাই হাইকোর্ট ও সুুপ্রিম কোর্টে গিয়ে নিজেরা হলফনামা দিয়ে বলে এসেছে, সপ্তম রাউন্ড পর্যন্ত কাউন্সেলিং বৈধ। তা হলে, এখন উল্টো কথা কীসের ভিত্তিতে? আসলে সরকার যোগ্যদের এখন অযোগ্য বানানোর খেলায় মেতেছে। চিহ্নিত টেন্টেড–দের মন জয় করতেই ওরা এটা করছে।’
সূত্রের খবর, এ দিন রাতে এসএসসি ভবনে আটকে পড়া আধিকারিকদের জন্য বাইরে থেকে খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। রাতে অফিস চত্বরে পিৎজা–সহ বিভিন্ন খাবারের ডেলিভারি আসতে দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন আন্দোলনকারীরা। অভিযোগ, তাঁরা ওই ডেলিভারি ভিতরে ঢুকতে দেননি। তার আগেই সেই খাবার মাটিতে ফেলে দেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষিকারা। চাকরিহারা বলতে থাকেন, ‘আমাদের পেটে ভাত নেই। খেতে পাচ্ছি না। সব হারিয়ে আজ বিপন্ন। অথচ সেই খাবার এসএসসি ভবনের আধিকারিকরা খাবেন?’ সিদ্ধার্থ–সহ অনেকেই রাত পর্যন্ত এসএসসি দপ্তরে আটকে থাকেন।
এ দিন রাতে আন্দোলনকারীরা প্রথমে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের জন্য টয়লেট এবং জলের ব্যবস্থা করতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ–প্রশাসন। যদিও পরে আশপাশের পেট্রল পাম্প, করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ড ও কাছাকাছি সুলভ শৌচালয় ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয় তাঁদের। পুরসভার ট্যাঙ্কারে করে জলেরও বন্দোবস্ত করা হয়। রাতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করেন আরজি কর ইস্যুতে প্রতিবাদী মুখ জুনিয়র ডাক্তার অনিকেত মাহাতরা, দেবাশিস হালদাররাও। তাঁরা আবার আন্দোলনকারীদের জন্য বায়ো–টয়লেট বসানোর দাবি জানান।
এই টানাপড়েনের মধ্যে আজ, মঙ্গলবার তথাকথিত ‘টেন্টেড’ বা ‘অযোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষিকাদের এসএসসি অভিযান কর্মসূচি রয়েছে আছে। ফলে এসএসসি ভবনের সামনে আন্দোলনরত ‘যোগ্য’দের সঙ্গে তাঁদের কোনও সঙ্ঘাত বাধে কি না, তা নিয়েও চিন্তায় পুলিশ–প্রশাসন। ইতিমধ্যে সল্টলেকের এই শিক্ষা সংক্রান্ত অফিসগুলির বাইরে বিরাট পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে।