পশ্চিম মেদিনীপুরে শালবনিতে জিন্দলগোষ্ঠীর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শিলান্যাস করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি ২০০০ একরের শিল্পপার্কেরও শিলান্যাস করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, শালবনির তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাজ্যের ২৩ টি জেলাই উপকৃত হবে। কর্মসংস্থান হবে ১৫ হাজার জনের।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে জিন্দল গোষ্ঠী ঘোষণা করেছিল, শালবনিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়া হবে। প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই ২৫ বছরের জন্য কিনে নেবে রাজ্য। সোমবার শিলান্যাসের পর মমতা জানিয়েছেন, উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নেওয়ার বিষয়ে রাজ্যের সঙ্গে ইতিমধ্যেই চুক্রি স্বাক্ষর হয়েছে জিন্দলদের। এমন প্রকল্প পূর্ব ভারতে কখনও হয়নি। এটি পরিবেশবান্ধব প্রকল্প। এই শিলান্যাসকে ”ঐতিহাসিক” বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
শালবনিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শিলান্যাস করে মমতা জানিয়েছেন, বক্রেশ্বর-দুর্গাপুরে ৬৬০ মেগাওয়াটের দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হবে। সাঁওতালডিতে ৮০০ মেগাওয়াটের আরও দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে আরও ৪৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। শালবনিতে ১৫ হাজার কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ডেউচা–পাঁচামিতে ১ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে। কারণ সেখানে বিশাল কোল ব্লক তৈরি হচ্ছে। স্কিল ট্রেনিং সেন্টারও তৈরি করবে রাজ্য। পাশাপাশি বাংলায় ছয়টি ইকনমিক করিডর তৈরি হচ্ছে। শুধু পশ্চিম মেদিনীপুরেই ৩৭০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পুরুলিয়ায় বিনিয়োগ করবে পাঁচটি বড় শিল্প সংস্থা। ৩০ তারিখ দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন হবে।
মমতা প্রশাংসা করে জিন্দল গোষ্ঠীর কর্ণধার সজ্জন জিন্দল বলেন, ‘লাখো নেতার মধ্যে এমন নেতা একজনই মেলে।’ জিন্দলদের সংস্থা ‘জেএসডব্লিউ এনার্জি’ শালবনিতে ৮০০ মেগাওয়াটের দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলতে ১৬,০০০ কোটি টাকা লগ্নি করছে। সজ্জন জিন্দল জানিয়েছেন, এই প্রকল্পে স্থানীয়রা কাজ পাবেন। গত ১০ বছরে শালবনিতে অনেক উন্নতি হয়েছে। এখানকার জমি কৃষকদের। তাই তাঁরা যাতে উপকৃত হন, তা দেখতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁকে সেই কথাই বার বার বলেছেন। এই তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে যাতে কোনও দূষণ না হয় তা নিশ্চিত করবেন জিন্দলরা।
এছাড়াও মুখ্যমন্ত্রীর আরও হিসাব, ২ হাজার ৪৮৩ একর জমিতে জঙ্গলসুন্দরী কর্মনগরী তৈরি হয়েছে। সেল গ্যাস রয়েছে আসানসোল ও দুর্গাপুরে, অশোকনগরে ওএনজিসি, বানতলায় লেদার হাব, নিউটাউনে সিলিকন ভ্যালি রয়েছে। সেই সঙ্গে তাজপুরেও শিল্প আসছে। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বাম সরকারকেও খোঁচা দিয়েছেন। বলেন, ‘আগে লোকে বলত লোডশেডিংয়ের সরকার, আর নেই দরকার! এই প্রকল্পের কারণে পরবর্তী ১০০ বছর বিদ্যুতের সমস্যা হবে না রাজ্যে। ২৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ পরিষেবা মিলবে।’ বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বিগত কয়েক বছরে কত খরচ হয়েছে তার খতিয়ানও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে ৭৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ৩.৫ লক্ষ লাইন ও ৭৫০ টার বেশি সাব স্টেশন তৈরি হয়েছে। আগে রাজ্যে ১ কোটি ৭ লক্ষ উপভোক্তা ছিলেন, এখন সেটা হয়েছে ২ কোটি ৩০ লক্ষ। মুখ্যমন্ত্রী এও বলেন, আগামী দিনে বিদ্যুতের জন্য আরও ৪৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হবে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা মনে করিয়ে দেন, বিজিবিএস-এ ৯৯ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছিল। তার মধ্যে ১৩ লক্ষ কোটি টাকা ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ হয়েছে। বিরোধীরা বারংবারই শিল্প ইস্যুতে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারকে নিশানা করে থাকে। সোমবারের অনুষ্ঠান থেকে বিরোধীদের পাল্টা আক্রমণ শানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমার সমালোচনা করতেই পারেন কিন্তু উপেক্ষা করতে পারবেন না। যাঁরা বলেন বাংলায় শিল্প হয় না, তাঁরা চোখ খুলে দেখে যান। আমরা কাজে করে দেখাই।’ মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বিজেপি, সিপিএম বা কংগ্রেসের মতো কোনও বিরোধী দলের নাম নেননি। কিন্তু এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর সকল ‘সমালোচক’কে একই বন্ধনীতে ফেলে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের নেতৃত্বে উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী এ দিনও রাজ্যে সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘আমি এটুকুই চাই, সবাই সবাইকে ভালোবাসুন, ভালো থাকুন।’ সম্প্রতি, একাধিক ইস্যুতে রাজ্যে শান্তির পরিবেশে সামান্য ছন্দপতন ঘটেছে। এই আবহে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশ বৈচিত্র্যের। আমাদের বিশেষত্ব হল এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই একতা। সেটা ভাঙার নয়, বরং আরও ঐক্যবদ্ধ হওয়া আমাদের লক্ষ্য। সকলে কাজের মধ্যে থাকুন। মনে রাখবেন, ইতিবাচকতাই মনের জোর বাড়ায়। ইতিবাচক কথা শুনলে চাঙ্গা হতে পারবেন।’