কথা ছিল সোমবার সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) তরফে যোগ্য এবং অযোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু তা এল না। রাত ১২টা ১৫ মিনিট নাগাদ এসএসসি বিবৃতি দিয়ে জানাল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের নড়চড় হবে না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমাফিক যাঁরা বেতন পাচ্ছেন, কেবল তাঁরাই বেতন পাবেন এবং চাকরি করবেন। ঘটনাক্রমে বিবৃতি দেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও। তিনিও একই কথা জানিয়েছেন। এর পর গভীর রাতে বিক্ষোভরত চাকরিহারাদের সঙ্গে দফায় দফায় ধস্তাধস্তি হয় পুলিশের।
সোমবার রাত ১২টার পরে এসএসসি-র চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার বিবৃতিতে বলেন, ‘‘২০১৬ সালে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে যে, এসএসসি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে চলবে। এবং বিভাগ কর্তৃক জানানো হচ্ছে, যে শিক্ষকেরা চাকরি করেছেন, তাঁদের বেতন বর্তমান ব্যবস্থা অনুসারে বিতরণ করা হবে।’’ অন্য দিকে, বিক্ষোভকারী চাকরিহারা শিক্ষকেরা জানিয়ে দেন, যোগ্য-অযোগ্যের তালিকা না পেলে তাঁদের আন্দোলন চলবে। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘কথা দিয়েও কথা রাখল না এসএসসি। এই ভাবে অযোগ্যদের বাঁচানোর প্রয়াস চলছে।’’ পাশাপাশি হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, এসএসসি চেয়ারম্যান তাঁদের সঙ্গে দেখা না করলে দফতরের সামনে থেকে তাঁরা নড়বেন না। বস্তুত, এসএসসি-র নির্দেশে নতুনত্ব কিছু দেখতে পাননি তাঁরা। তা হলে কেন এত ক্ষণ সময় নেওয়া হল, প্রশ্ন তোলেন চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষকেরা।
বস্তুত, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল রায়ের পর থেকে চাকরিহারারা দাবি করেছিলেন, যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করা হোক। ওই দাবি নিয়ে গত ১১ এপ্রিল বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে বৈঠক করেন ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের প্রতিনিধিরা। সেই বৈঠকে ছিলেন এসএসসি চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থও। সে দিন বৈঠক শেষে চাকরিহারারা জানান, ২১ এপ্রিলের মধ্যে ‘যোগ্য’ এবং ‘অযোগ্য’দের তালিকা প্রকাশের বিষয়ে তাঁরা আশ্বাস পেয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীও জানিয়েছিলেন, ইতিমধ্যে যোগ্য-অযোগ্যদের তালিকা তৈরি করতে শুরু করেছে এসএসসি। আইনি পরামর্শ নিয়ে তাঁরা ২১ এপ্রিলের মধ্যেই ওই তালিকা প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা করবেন। কিন্তু ২১ এপ্রিল তালিকা আসেনি। চাকরিহারা বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, তাঁদের প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বোকা বানিয়ে রাখার চেষ্টা করছে রাজ্য সরকার থেকে এসএসসি। কিন্তু এ বার আর ‘ললিপপ’ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন না তাঁরা। তাই রাতভর এসএসসি দফতর ঘেরাও করছেন। তালিকা না পাওয়া পর্যন্ত ওই জায়গা থেকে তাঁরা সরবেন না। রাতে চাকরিহারা শিক্ষক চিন্ময় মণ্ডল বলেন, ‘‘ওঁরা (এসএসসি-র কর্তারা) এসি ঘরে বসে থাকুন। ওঁরা স্যালারি পাচ্ছেন। আর আমাদের বলা হচ্ছে, আপাতত স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করতে। রাজ্যের সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রীকে বলব, সব ছেড়ে এসএসসি অফিসের সামনে আসুন। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল ফেরাতে একজোট হোন।’’ আর এক চাকরিহারা শিক্ষক বলেন, ‘‘আমরা বলে এসেছি, আপনি (এসএসসি-র চেয়ারম্যান) কথা বলুন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। যদি এই ভাবে আমাদের চাকরি কেড়ে নেন, ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘ইয়ার্কি পেয়েছে! যে রকম নাচাবে সে রকম নাচব? গুলি করে মেরে দিন।’’ এর মধ্যে রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ এসএসসি ভবনের ভিতরে খাবার নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সেই খাবার ছুড়ে ফেলে দেন চাকরিহারা বিক্ষোভকারীরা। তাঁদের কথায়,‘‘আমাদের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে ওঁরা খাওয়াদাওয়া করবেন? না, হবে না।’’
কী কথা হয়েছিল এসএসসির সঙ্গে?
শিক্ষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথাবার্তার পর প্রায় ৫ ঘণ্টা পরে বেরিয়ে আসেন চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতিনিধিরা। তার মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়িয়েছেন বাইরে থাকা চাকরিহারা শিক্ষকেরা। দফায় দফায় বিক্ষোভ হয়েছে। তাঁদের প্রতিনিধিরা এসএসসি দফতরের বাইরে এসে জানান, এই বৈঠকের কোনও সারবত্তা নেই। এখন এসএসসি বলছে, আইনি পরামর্শ নেবে তারা! এক চাকরিহারা শিক্ষকের কথায়, ‘‘ওঁরা ঠিক করেই উঠতে পারছেন না কী করবেন! কাউন্সিলিংয়ের কোনও কথা বলেননি। আমরা যোগ্য। ওঁরা অন্য ভাবে লিস্ট (তালিকা) প্রকাশ করতে চাইছিলেন। ওঁরা খালি বলছেন, ‘পরে পরে।’ কথা রাখেনি কমিশন (স্কুল সার্ভিস কমিশন)।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘‘কিচ্ছু বলেনি। কোনও সুরাহা নেই। কিচ্ছু হল না। ওরা দুর্নীতি করল, টাকা খেল, আর আমার চাকরি চলে যাবে! আমি অযোগ্য? ইয়ার্কি হচ্ছে এখানে? বলছে, ফোর্থ কাউন্সেলিং থেকে সব কাউন্সেলিং বাতিল। কিসের জন্য? আমরা তো টাকা দিইনি? তা হলে কিসের জন্য স্যালারি থাকবে না? স্কুলে যেতে পারব না? কেন অযোগ্য চিহ্নিত হব? মামার বাড়ির আবদার নাকি? আমরা ঘেরাও করে রাখব। কাউকে যেতে দেব না, নিজেরাও যাব না।’’
‘আপনাকে ঘেরাও করা হচ্ছে’
চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতিনিধি হিসাবে কৃষ্ণকান্ত রায় গিয়েছিলেন এসএসসি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে। প্রায় ৫ ঘণ্টা পর তিনি যখন বেরোলেন চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘‘টাকা খেল নেতারা। আর লোকে আমাকে বলবে, টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে। আমাদের বলা হবে, টাকা দিয়ে চাকরি করছে। মামার বাড়ির আবদার! আমার চাকরি, সম্মান গিয়েছে তোমাদের দোষে। তোমরা কী ভাবে আমার চাকরি রাখবে, সেটা নিজেরা ঠিক করো।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘চেয়ারম্যানকে (এসএসসি) বলে এসেছি, ‘আপনাকে ঘেরাও করা হচ্ছে।’’’ কৃষ্ণকান্ত রায়, চিন্ময় মণ্ডলেরা এ-ও জানান, তালিকা প্রকাশ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি এসএসসি। কৃষ্ণকান্ত বলেন, ‘‘আমরা আশাহত। যোগ্য-অযোগ্যের তালিকা আলাদা করে প্রকাশ করা হবে বলে জানতাম। কিন্তু পুরোটাই গুলিয়ে দেওয়া হল। চতুর্থ তালিকা থেকে সবাইকে অযোগ্য করে দেওয়া হচ্ছে। ওঁরা আর তালিকা দেওয়ার কথা বলেননি। যত ক্ষণ না তালিকা দেওয়ার কথা বলা হবে, আমরা এখানে অবস্থানে থাকব। বেতন চাই না। আগে যোগ্য এবং অযোগ্যদের তালিকা দেওয়া হোক।’’ সেই থেকে ঘেরাও হয়ে রয়েছেন সিদ্ধার্থেরা। বস্তুত, তাঁরা যাতে যোগ্য-অযোগ্যদের তালিকা প্রকশ না করে বেরোতে পারেন, সে জন্য ভবনের দু’টি ফটকের সামনে ঘিরে বসে থাকেন চাকরিহারারা।
শিক্ষামন্ত্রী এবং এসএসসি-র চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি
চাকরিহারাদের দাবি, এসএসসি প্রতি মুহূর্তে প্রথম থেকে তাদের মিথ্যা বলেছে। তাঁদের ক্রমশ বিপদের মুখে ফেলে দিচ্ছে। এক চাকরিহারা শিক্ষিকার কথায়, ‘‘আমরা বিচার চাই। আমরা এখনই এসএসসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাই। এখনও শুধু টালবাহানা করছেন উনি। আজ ওঁকে ওখান থেকে নামতে হবে। আজই ওঁকে সিংহাসন থেকে নামাব আমরা।’’ অন্য দিকে, সোমবার সারা দিন চাকরিহারাদের বিক্ষোভ এবং অভিযোগের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী বা এসএসসি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কোনও বিবৃতি আসেনি। এসএসসি-র চেয়ারম্যান বিবৃতি দেওয়ার কথা বললেও রাত ১২টার পরেও তালিকা আসেনি। তার পর রাত ১২টার পর ওই বিবৃতি দেয় এসএসসি। তার কিছু ক্ষণ বাদে ব্রাত্য বসু বলেন, ‘যাঁরা বঞ্চিত শিক্ষক তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো তাঁদের মাইনে পাওয়া নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তাই এই আন্দোলনেরও কোনও মানে নেই। আর যাঁরা ওখানে আছেন (এসএসসি দফতরের সামনে বিক্ষোভকারী চাকরিহারারা), তাঁদের অনেকেই হয়ত অযোগ্য। তাঁদের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট কোনও গাইডলাইন না দিলে তো আমরা কিছু বলতে পারি না। আমরা দ্রুত রিভিউ পিটিশনের জন্য যাচ্ছি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টই আমাদের গাইডলাইন দিয়ে দেবেন। আমরা যে ভাবে এগোচ্ছি, তাঁদের আস্থা রাখা উচিত। এ বার আস্থা রাখবেন কি রাখবেন না, সেটা তাঁদের ব্যাপার।’’
এসএসসি-র বিবৃতির পর নামল র্যাফ
এসএসসি বিবৃতি দেওয়ার পরে র্যাফ নামানো হয় এসএসসি দফতরের সামনে। কাঁদানে গ্যাস নিয়ে দেখা যায় পুলিশকেও। অন্য দিকে, চাকরিহারা শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা ওই জায়গা থেকে নড়বেন না। এক চাকরিহারা শিক্ষিকা বলেন, ‘‘মারুক। তবু এখানেই থাকব। এখানেই রাত কাটাব। মার খেলে দায় কিন্তু এই সরকারেরই।’’
রাতেই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দেখা করতে যান ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের সদস্যেরা। আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে যে জুনিয়র ডাক্তারেরা আন্দোলনে নেমেছিলেন, সেই অনিকেত মাহাতো, দেবাশিস হালদার, আসফাকুল্লা নাইয়ারা গিয়েছিলেন আন্দোলনরত চাকরিহারা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন। অনিকেত বলেন, ‘‘পুলিশের মুখ আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি, কী ভাবে তক্তাপোশ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। দেখেছি, কী ভাবে গাড়ি আটকে দেওয়া হয়েছিল। আমরা সমাজের প্রচুর মানুষকে পাশে পেয়েছিলাম। আজ শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াতে এসেছি।’’ দেবাশিস বলেন, ‘‘মূলত দুটো কারণে এসেছি। ওঁরা জল, খাবার পাচ্ছেন না। টয়লেট নেই। এখন প্রায় দু’হাজার মানুষ বসে আছেন। প্রশাসনের উচিত ছিল ব্যবস্থা করা। কিন্তু তারা করেনি। ওদের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি হয়েছে। আর পুলিশের ভূমিকা ন্যক্কারজনক।’’
রাত ১টা নাগাদ পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় বিক্ষোভকারীদের। চাকরিহারাদের দাবি, রাতে আচার্য সদনে ঢুকতে গিয়েছিলেন বিধাননগর কমিশনারেটের আধিকারিক এবং কর্মীরা। এসএসসি-র চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদারকে নিরাপত্তা দিয়ে বার করে নিয়ে যেতে চায় পুলিশ। কিন্তু তাঁরা সেটা হতে দেবেন না। প্রথমে পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি, পরে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় চাকরিহারা শিক্ষকদের। শিক্ষিকাদের অভিযোগ, তাঁদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে। ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত মহিলা পুলিশ নেই। যদিও এই অভিযোগ উড়িয়ে দেয় পুলিশ। বিধাননগরের ডিসি অনীশ সরকার বলেন, “পুলিশ একটা সিস্টেমে কাজ করে। আমরা আমাদের ডিউটি করছি। শিফ্টিং চলছে। আমাদের এক পুলিশকর্মী সাদা পোশাকে ছিলেন। তিনি বেরোচ্ছিলেন। আন্দোলনকারীরা ভেবেছেন, উনি এসএসসির কর্মী। তেমনটা নয়। উনি পুলিশকর্মী। আমরা ওঁদের লিডারের সঙ্গে কথা বলেছি। ওঁরা বুঝতে পেরেছেন। মিটে গেছে। আমরা আছি এখানে।” তিনি আরও বলেন, “আমাকে আটকানো হয়ছিল। মহিলা অফিসারেরা আসেন। যখন যাই তখন ধাক্কা দেওয়া হয়, কিন্তু আমরা বিষয়টা সামলে নিতে পেরেছি। ওঁদের প্রতিনিধি এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন।” অন্য দিকে, এক আন্দোলনকারী বলেন, “সাদা পোশাকের এক জন পুলিশকর্মী বেরোচ্ছিলেন। আমরা পরে বুঝতে পারি, উনি পুলিশ। পুলিশ যাবেন বা আসবেন, আমাদের তাতে আপত্তি নেই। এসএসসির কোনও কর্মীকে আমরা বেরোতে দেব না।’’