এই সময়: মাথায় বালিশ নেই। বুকের কাছে খামচে ধরা ব্যাগপ্যাক। পথবাতির জোরালো আলো চোখের উপরে। তবু দিনভরের ক্লান্তিতে এবড়ো খেবড়ো পিচ রাস্তায় পাতলা চাদর পেতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন চাকরিহারা, আন্দোলনকারী শিক্ষিকা। শিক্ষিত তরুণীকে রাস্তায় দাঁড় করিয়েছে পরিস্থিতি। আর তিনি তো একা নন। যে রাস্তা ধরে নিয়মিত যানবাহনের যাতায়াত, সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে করুণাময়ী যাওয়ার সেই পথেই সার দিয়ে ঘুমোচ্ছেন আরও অনেক শিক্ষিকা।
সোমবার রাত তখন প্রায় দুটো। সেক্টর ফাইভ থেকে উইপ্রো মোড় ছাড়িয়ে করুণাময়ীর দিকে এগোলেই বাঁ–দিকে পড়ে পেট্রল পাম্প। যার পাশেই স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)– এর অফিস ‘আচার্য ভবন’। বড় রাস্তার দিকে একটি গেট, পাশের গলিতে আর একটি। ওই রাতে দু’টি গেটের সামনেই ভিড়। গেটের বাইরে চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষিকারা। হাতে গোনা ক’জন হয়তো তাঁদের আত্মীয়–বন্ধু–সমর্থক। আর গেটের ভিতরে ঠাসাঠাসি পুলিশ। আশপাশের বাড়িতে তখন ঘুমের ছায়া।
দিনভরের আন্দোলনের পরেও এসএসসি–র গেটে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলছিলেন কর্মহারাদের একাংশ। বড় সংখ্যক অবশ্য তখন শুয়ে পিচ রাস্তার উপরে। স্মিতা মণ্ডল নামে একজন বললেন, ‘পালা করে রাত জাগা হচ্ছে। একটু তো ঘুমিয়ে নিতে হবে। না হলে লড়ব কী ভাবে?’ আশপাশ থেকে এল অভিযোগ — ‘দাদা, এলাকার মানুষ তো ওয়াশরুমটা খুলে দিতে পারেন! পেট্রল পাম্পে একটিই শৌচালয়। ও দিকে করুণাময়ী বাস স্ট্যান্ডে যেটা আছে, সেটাও রাত আটটার পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এত মহিলা। এঁরা যাবেন কোথায়?’
অভাব পানীয় জল, খাবারেরও। ডিনারে কেউ কেউ খান কতক বিস্কুট খেয়েছেন। পরিস্থিতি জানতে পেরে রাতেই জল ও কিছু খাবার নিয়ে হাজির হন দুই চিকিৎসক বিপ্লব চন্দ্র ও অনিকেত মাহাতো। তাঁদের কথায়, ‘এত রাতে এটুকুই জোগাড় করতে পেরেছি। তিন মিনিটের মধ্যে তার সবই শেষ।’
মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছেন এক ইংরেজির শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘সকালে ট্রেনে চেপে এসেছি। কতদিন থাকতে হবে জানি না। মোবাইলের চার্জ শেষ। বাড়িতেও যোগাযোগের উপায় নেই। কোথায় চার্জ দেবো জানি না।’ রাতে ফেসবুকে জ্বলজ্বল করছিল বিক্ষোভে সামিল কোনও এক চাকরিহারা শিক্ষকের পোস্ট — ‘সল্টলেক করুণাময়ীর কাছে যাঁদের বাড়ি, তাঁরা প্লিজ় একটু জল আর টয়লেটের জন্য দরজা খুলে দিন। হাতজোড় করে মিনতি করছি। আমরা চোর নই। যোগ্য শিক্ষক–শিক্ষিকা।’ মঙ্গলবার সকালে মেলে সাড়া। এসএসসি ভবন লাগোয়া বেশ কিছু বাড়ির বাসিন্দাই আন্দোলনকারীদের জন্য দরজা খুলে দেন। পানীয় জল, শুকনো খাবার নিয়েও হাজির হন অনেকে।
নদিয়ার চাকদহের বাসিন্দা রেহেনা বিবি নিজের তিন বছরের ছেলে বিভানকে সঙ্গে নিয়েই সামিল আন্দোলনে। মঙ্গলবার দুপুরে ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর ফাঁকে বলেন, ‘বাড়িতে ওকে দেখার মতো কেউ নেই। বাধ্য হয়ে নিয়ে এসেছি। এই গরমে কত দিন এ ভাবে বসে থাকতে হবে জানি না। তবে যত কষ্টই হোক, দাবি পূরণ না হলে লড়াই জারি থাকবে।’
এক বছরের ছেলেকে বাড়িতে রেখে সোমবারই কলকাতায় এসেছেন মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জের বাসিন্দা প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী। ফোনের চার্জ শেষ। বলেন, ‘সোমবার রাতে প্রশাসনের তরফে একটা বায়ো–টয়লেটও দেওয়া হয়নি। শৌচালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলে কী করব, সে চিন্তায় অনেকে জলও খায়নি ঠিক করে।’
এ দিন বিকেলে বেশ ক’জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদেরই একজন সাবিনা কিস্কু। ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের তরফে তাঁকে বিধাননগরের একটি স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সন্ধেবেলা।