• ‘বাঁচান স্যর! আমি পড়তে চাই’, এক ফোনেই বিয়ে রুখল নাবালিকা
    এই সময় | ২৩ এপ্রিল ২০২৫
  • সুমন ঘোষ, খড়্গপুর

    কয়েকদিন ধরেই কিশোরীটি আঁচ করতে পারছিল, তার বিয়ের একটা ‘তোড়জোড়’ চলছে বাড়িতে, তাকে অন্ধকারে রেখে। বিপদের গন্ধ পেয়ে সপ্তাহখানেক আগে সে ফোন করে নিজের স্কুলের প্রধান শিক্ষককে। নিজের ফোন নম্বর দিয়ে প্রধান শিক্ষক ওই ছাত্রীকে আশ্বাস দেন, বিয়ের দিন পাকা হওয়ামাত্রই যেন সে তাঁকে জানায়। কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।

    সোমবার বিকেলে আচমকা ফোন প্রধান শিক্ষকের কাছে। কিশোরীর আর্তি, ‘বাঁচান স্যর। আমি পড়তে চাই। বাবা-মা আজই জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে।’ আর দেরি করেননি প্রধান শিক্ষক। ফোন করেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের নারী, শিশু ও জনকল্যাণ স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষকে।

    খোদ মুখ্যমন্ত্রীর শালবনির সভাস্থল ছেড়ে কর্মাধ্যক্ষ দ্রুত ছুটে যান কিশোরীর বাড়িতে। যদিও সেখানে গিয়ে বিয়ের কোনও প্রমাণ পাননি। তবে কিশোরীর বিয়ে বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেন তিনি। মেয়েটির বাবা-মায়ের কাছে মুচলেকাও নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

    প্রশাসনিক সূত্রের খবর, পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার একটি গ্রামের ওই ছাত্রীটি কয়েকদিন আগেই আঁচ পেয়েছিল, একটি ছেলের সঙ্গে গোপনে তার বিয়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন বাবা-মা। আড়ালে তাঁদের কথাবার্তায় এটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি ডেবরা হরিমতী সারস্বত বিদ্যাপীঠ থেকে এ বছরই মাধ্যমিক দেওয়া ওই কিশোরীর।

    এক সপ্তাহ আগেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অসীম মাইতিকে ফোনে বিষয়টি জানিয়ে রেখেছিল সে। বাড়ির অলক্ষে পাড়ার একজনের মোবাইল থেকে প্রধান শিক্ষককে ফোন করে মেয়েটি। প্রধান শিক্ষক আশ্বাস দিয়েছিলেন, তেমন অঘটন ঘটলে অবশ্যই যেন জানায়। এরপর সোমবার দুপুরে বাড়িতে বিয়ের সরঞ্জাম কেনাকাটা দেখে মেয়েটি নিশ্চিত হয়, ওই দিনই তার বিয়ে হতে চলেছে।

    বিকেল ৩টে নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রধান‌ শিক্ষককে আবার ফোন করে কিশোরী কাতর অনুরোধ করে, ‘স্যর, আজই আমার বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বাড়িতে। সন্ধে হলেই বিয়ে দেবে। কিছু একটা করুন স্যর। আমি বিয়ে করতে চাই না। পড়তে চাই।’ প্রধান শিক্ষক অসীম মাইতি মঙ্গলবার বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পরে সঙ্গে সঙ্গে ডেবরা ব্লকের কন্যাশ্রী প্রকল্পের নোডাল অফিসার এবং নারী, শিশু ও জনকল্যাণ স্থায়ী কর্মাধ্যক্ষকে বিষয়টি জানাই। আমিও মেয়েটির বাড়ির কিছুটা দূর থেকে বিষয়টি নজর রাখছিলাম।’

    প্রধান শিক্ষক যখন ফোন করেন, তখন শালবনিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে ছিলেন কর্মাধ্যক্ষ শান্তি টুডু। প্রধান শিক্ষকের ফোন পেয়েই মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থল থেকে বেরিয়ে পুলিশ নিয়ে ডেবরার গ্রামে ছুটে যান কর্মাধ্যক্ষ। সেখানে গিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানের কোনও প্রমাণ না পেলেও মেয়ের বাবা-মাকে বুঝিয়ে মেয়েটির বিয়ে বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন। তবু আবার লুকিয়ে যাতে ওঁরা মেয়েটির বিয়ে না দেন তার জন্য নজরদারিও চালানো হচ্ছে বলে জানান শা‌ন্তি।

    কারণ, তিনদিন আগেই ডেবরা লাগোয়া সবং ব্লকে লুকিয়ে নাবালিকার বিয়ে দেয় পরিবার। বাবা-মাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নাবালিকাকে পাঠানো হয় হোমে। শান্তি জানান, ‘এ ক্ষেত্রে যাতে তেমন অঘটন না ঘটে, তাই নজরদারি চালানো হচ্ছে। মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে সকলে ব্যস্ত থাকায় আজ, বুধবার ভিলেজ লেভেল চাইল্ড প্রোটেকশন কমিটির বৈঠক ডেকে বাল্যবিবাহের কুফল বোঝানো হবে।

    ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটির যাতে বিয়ে না দেওয়া হয় সেই মুচলেকাও লেখানো হবে। মেয়েটির পড়াশোনাতেও সাহায্য করা হবে।’ প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘মেয়েটি পড়াশোনায় ভালো। তাই আরও পড়তে চায়। এমন মেয়ে আমাদের কাছে সত্যিই গর্বের।’ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা হবে বলে জানিয়েছেন কর্মাধ্যক্ষ।

    প্রশাসন সূত্রের খবর, ওই ব্যক্তির তিন মেয়ে। তিনি একটি চায়ের দোকান চালিয়ে সংসার চালান। বড় মেয়ের বয়স সবে ১৬ পেরিয়েছে। এক পাত্রের পছন্দ হওয়ায় দ্রুত বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগেন। সকলে বোঝানোর পর ছাত্রীর বাবা অবশ্য বলেন, ‘মেয়ের বিয়ের উপযুক্ত বয়স হওয়ার পরেই বিয়ে দেব।’

  • Link to this news (এই সময়)