দিব্যেন্দু সরকার, আরামবাগ
সোমবারই ছিল বিশ্ব বই দিবস। বই বললেই মনে আসে সাবেক সেই সব পাঠাগারের কথা। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা সেই সব পাঠাগারই একটা সময়ে মানুষের পড়ার অপরিসীম খিদে মেটাত। পাঠাগারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এক ভিন্ন সংস্কৃতি। আজ তা 'সাবেক' এই জন্য, এখন বিভিন্ন কারণে পাঠাগারগুলি হয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে, না হলে বেশির ভাগ নতুন প্রজন্মের কাছে পাঠাগারের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণাই গড়ে ওঠেনি। কী সেই কারণ, যার ফলে ধুঁকছে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পাঠাগার?
হুগলির আরামবাগ মহকুমায় এই মুহূর্তে মোট ৪০টি পাঠাগার আছে। কিন্তু ধুঁকছে সেগুলি। মহকুমা গ্রন্থাগারে মোট ১২ হাজার ৮৯৪টি বই আছে। গোটা মহকুমায় পাঠাগারগুলি প্রায় বন্ধের মুখে। পড়ুয়াদের অভাবে ধুঁকছে। আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৩০-৪০ জন পড়ুয়া আসতেন, সেখানে আজকাল আসেন মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন। তা-ও অনিয়মিত। আরও খোঁজখবর করে জানা গেল, পড়ুয়াদের অনীহার অন্যতম কারণ হলো, মুঠো ফোন। আজ মোবাইলেই বেশি আসক্ত অধিকাংশ তরুণ সমাজ। পাশাপাশি, অপর্যাপ্ত কর্মী, অনিয়মিত পাঠাগার খোলা, এগুলিও অন্যতম কারণ। অনেক সময়ে একই ব্যক্তি তিন-চার জায়গার পাঠাগারে গিয়ে দায়িত্বভার সামলান। পাঠাগার খোলা-বন্ধও যে কারণে অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। এই সব কারণেই মহকুমায় পাঠাগারগুলির অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
পাঠাগারে নিয়মিত যাতায়াতকারী পড়ুয়াদের বক্তব্য, আগে বই পড়াকে ভালোবাসতে হবে। সব কিছু কিন্তু মোবাইল ফোনে হয় না। সহজে, হাতের কাছে কিছু তথ্য মেলে, এটা ঠিক, কিন্তু তা কখনওই বইয়ের বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু মানুষ তা-ও যাচ্ছেন না। আগে পাঠাগারে অনুষ্ঠান হতো, এখন সে সব প্রায় বন্ধের মুখে। তরুণ সমাজকে পাঠাগারমুখী করতে পারে, এমন কোনও আকর্ষক কিছুই আর ঘটে না পাঠাগারগুলিতে। এই মুহূর্তে আরামবাগ মহকুমা পাঠাগারের দায়িত্বে আছেন সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি চন্দননগর মহকুমা পাঠাগারেরও দায়িত্বে। পাশাপাশি, উত্তরপাড়া কোতরং পাঠাগারেও যান অতিরিক্ত দায়িত্বভার সামলাতে।
তিনি বলেন, 'পাঠাগারগুলিতে ঘোরতর কর্মী-সঙ্কট। কর্মী না থাকায় নিয়মিত লাইব্রেরি খোলা যায় না। আমি আরামবাগে আসি দু'দিন। বাকি আরও কয়েকটা জায়গায় যাই। তবে নিছক মোবাইল ফোনের প্রতি আকর্ষণের কারণেই যে পড়ুয়া কমছে, তা নয়। বলা যেতে পারে, এটা অন্যতম কারণ। পাঠাগারগুলি নিয়মিত খুলতে হবে। আগে নানা রকম অনুষ্ঠান হতো। এখন তা হয় না। পড়ুয়াদের বইমুখী করতে হবে এই সব কিছুর মাধ্যমেই। আমরা তবুও চেষ্টা করি, যাতে পড়ুয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বইয়ের সংখ্যা যথেষ্টই আছে। নিউজ পেপারও নেওয়া হয়।'
এই পাঠাগারের প্রাক্তন তথা অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক বিভাংশু দত্ত বলেন, 'সমস্যা তো আছেই। কর্মীসংখ্যা সত্যিই কমে গিয়েছে। পর্যাপ্ত কর্মী থাকলে, প্রতিদিনই পাঠাগার খোলা যায়। পড়ুয়ার সংখ্যাও বাড়ানো সম্ভব।' পড়ুয়াদের মধ্যে বিশ্বরূপ মালিক, সুষমা ধাড়া রায়, টগর মণ্ডলরা এসেছিলেন দূরবর্তী গ্রাম থেকে। এঁদের মতে, আগে বই পড়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে, নিয়মিত পাঠাগারগুলি খোলা দরকার, তবেই পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়বে। পাঠাগার কর্তৃপক্ষকেও আকর্ষক কিছু করতে হবে, সাধারণ মানুষকে লাইব্রেরির পথে আনতে গেলে। এর জন্য রীতিমতো ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। এখন প্রশ্ন এটাই, এই সব সমস্যার মোকাবিলা করে ফের কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে চিরকালীন পাঠাগার-সংস্কৃতি?