হিন্দু? জিজ্ঞেস করেই গুলি, ৩ মৃত্যু, গোটা বাংলা বাকরুদ্ধ
বর্তমান | ২৪ এপ্রিল ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: কথা ছিল বৃহস্পতিবার বাড়ি ফিরবেন বিতান অধিকারী, সমীরবা গুহরা। কথা ছিল, অনেক স্মৃতি, ক্যামেরা ভর্তি ছবি, প্রিয়জনের জন্য উপহার নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু কথা রাখলেন না তাঁরা। সময়ের একদিন আগেই ফিরলেন। কিন্তু কফিনবন্দি হয়ে। সকলকে কাঁদিয়ে। বুধবার রাত ৮টা নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দরের ৪ নম্বর গেট দিয়ে বিতান ও সমীরের নিথর কফিনবন্দি দেহ বেরিয়ে এল। আর বিতানের স্ত্রী সোহিনীর কান্না থামছে না। সমীরের স্ত্রী শর্বরী, মেয়ে শুভাঙ্গীর চোখের জলও শুকিয়ে গিয়েছে। শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। বিতানের সাড়ে তিন বছরের ছেলে হৃধান কিছুই বুঝতে পারছে না। কার্যত বাকরূদ্ধ হয়ে চারপাশে তাকিয়ে রয়েছে সে। বাকরুদ্ধ গোটা বাংলাও। বিমানবন্দরের বাইরে অজস্র মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে। চারদিকে শুধু পুলিস আর কেন্দ্রীয় বাহিনী।
স্বামীর কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে সোহিনী বলে চলেছেন, ‘আমার ছেলে চোখের সামনে দেখল... ওর বাবাকে সন্ত্রাসবাদীরা মেরে ফেলল।’ বিতানকে নিয়ে চলেছে সুসজ্জিত শববাহী গাড়ি। তার পাশ দিয়েই চোখের জল ফেলতে ফেলতে তাঁর স্ত্রীয়ের গাড়িটি এগচ্ছে। চারপাশকে গ্রাস করেছে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। তেরঙা হাতে নিয়ে লোকজনের চোখেমুখে ক্রোধ। তাঁদের কথাবার্তায় শুধুই ‘বদলা’ নেওয়ার অদম্য ইচ্ছা। বিমানবন্দরজুড়ে মানুষজনের মধ্যে একটাই আলোচনা, একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘হিন্দু জিজ্ঞেস করেই কি ওঁদের মেরে দিল?’ সমীর গুহকে এমনই প্রশ্ন তো করেছিল জঙ্গিরা! আই কার্ড দেখেছিল। তারপরই গুলি। কেউ বলছেন, ‘সন্ত্রাসবাদীদের আসলে কোনও ধর্ম হয় না।’ বিতর্ক চলতেই থাকছে। কিন্তু এসব কিছুই বোঝে না বিতানের সাড়ে তিন বছরের ছেলে হৃধান। হঠাত্ই তার জীবনটা বদলে গেল। বাবা নেই। বাবাকে গুলি করেছে। সোহিনীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বিমানবন্দরের কর্মী থেকে শুভানুধ্যায়ীরা। শববাহী গাড়ির পিছনে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন পরিবারের সদস্যরা। ৪ নম্বরের গেটের ভিতরেই রাজ্য সরকারের তরফে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস সহ কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলাররা উপস্থিত হয়েছিলেন এদিন। এছাড়া পৌঁছে যান বিজেপির নেতানেত্রীরাও। রাতে বিমানবন্দর থেকে বিতানের মরদেহ নিয়ে আসা হয় তাঁর গড়িয়ার বৈষ্ণবঘাটা লেনের বাড়িতে। সেখানে প্রতিবেশীরা সোহিনী ও তাঁর ছেলেকে পেয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন। পাড়াজুড়ে তখন শুধু কান্নার কলরোল। বিতানের বৃদ্ধ বাবা-মা সন্ধ্যাতেই বেহালা থেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন গড়িয়ার বাড়িতে। ছেলের এই মর্মান্তিক পরিণতি দেখে নিজেদের ধরে রাখতে পারেননি তাঁরা। একই চিত্র দেখা যায় সমীর গুহর সখেরবাজারের পাড়ায়। স্থানীয় ক্লাবে তাঁর বন্ধুরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বন্ধুকে শেষ দেখার জন্য। নিমেষেই গোটা পাড়ায় শশ্মানের নিস্তব্ধতা। তারই মধ্য দিয়ে চাপা কান্না ভেসে আসে। পাড়া-প্রতিবেশীদেরও একটাই বক্তব্য, ‘বদলা চাই!’ মেনে নিতে পারছেন না কেউ। বাংলার আর এক নিহত মনীশরঞ্জন মিশ্রর দেহ অবশ্য বুধবার ফেরেনি। ‘তাঁকে আনতে’ আত্মীয়রা দিল্লির উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। রাঁচি হয়ে বৃহস্পতিবার তাঁর কফিনবন্দি দেহ পুরুলিয়ার ঝালদার বাড়িতে ফেরার কথা।
এদিন নবান্নে মন্ত্রিসভার বৈঠকের শুরুতেই পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হানার মৃতদের উদ্দেশে শোক প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মর্মান্তিক এই ঘটনায় দোষীদের দ্রুত এবং কড়া শাস্তির দাবি তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদীরা জন্মগত অপরাধী। এদের কোনও জাত, ধর্ম হয় না। আমরা শুনেছি বেছে বেছে মারা হয়েছে। ওখানে তো সেনাবাহিনী ছিল! এমনিতেও সীমান্তবর্তী ও স্পর্শকাতর এলাকা। তবে এসব নিয়ে এখন আমরা প্রশ্ন তুলতে চাই না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’ গোটা বাংলাও যে এটাই চায়।