নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা, চুঁচুড়া ও সংবাদদাতা, উলুবেড়িয়া: আবারও অশান্ত কাশ্মীর। পহেলগাঁও থেকে শ্রীনগর—বাতাসে ফের বারুদের গন্ধ। অবিশ্বাসের বাতাবরণ। ভূস্বর্গ-ভ্রমণ চুলোয় যাক, আগে প্রাণটা তো বাঁচুক! তাই স্বপ্ন-সফর অসমাপ্ত রেখে আতঙ্ক সঙ্গী করেই কাশ্মীর ছাড়ছেন দলে দলে বাঙালি পর্যটক।
মঙ্গলবার সন্ত্রাসবাদীরা যেখানে গুলি চালাচ্ছিল, সেই ভ্যালিতেই যাচ্ছিলেন ব্যান্ডেলের দে পরিবারের সদস্যরা। যাওয়ার পথে পরিবারের সদস্য চঞ্চল দে জানতে পারেন, পহেলগাঁওতে গুলি চলেছে। রাস্তায় লাগাতার অ্যাম্বুল্যান্স ও সাঁজোয়া গাড়ির আনাগোনাও লক্ষ করেন কুন্তীঘাটের স্কুলশিক্ষক চঞ্চলবাবু। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী পর্ণা ও আট বছরের ছেলে অর্চিষ্মান। কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল থেকে ফোন আসে ফিরে আসার জন্য। দ্রুত তাঁরা ফেরার পথ ধরেন। তারপর বিনিদ্র রাত কেটেছে তাঁদের। পর্ণাদেবী সন্তানকে বুকে চেপে জেগেছিলেন সারারাত। বুধবার সকাল হতেই কাশ্মীর ছাড়েন তাঁরা। ব্যান্ডেলের টায়ারবাগানের দে বাড়িতে সকলেই উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। চঞ্চলবাবুর বৌদি বাসন্তীদেবী জানান, ‘টিভিতে খবর পরে দেখেছি। তার আগে পর্ণাই ফোন করে খবরটা জানায়। ওরা ঘুরপথে ফিরছে। ওদের জন্য খুব চিন্তায় আছি।’ ফোনে চঞ্চলবাবু বলেন, ‘জোর বেঁচে গিয়েছি।’ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে তাঁদের ছোট্ট সন্তানও। আগেও দু’বার ভূ-স্বর্গ গিয়েছেন চঞ্চলবাবু। তৃতীয়বারের সফর তাঁকে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করিয়েছে।
একই অভিজ্ঞতার সাক্ষী কোন্নগরের অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী সুজিত সেন ও তাঁর স্ত্রী শুক্লা সেন। ফোনে সুজিতবাবু বলছিলেন, ‘পহেলগাঁও যাচ্ছিলাম। হঠাৎ রাস্তা বন্ধ করে দিল আর্মি। অন্ধকার রাস্তা, গলিপথ ধরে কোথা দিয়ে কীভাবে যে শ্রীনগরে এসেছি, বলতে পারব না। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ একটি হোটেলে আসি।’ তিনি জানালেন, বুধবার সকাল থেকে গোটা কাশ্মীরে কার্যত বন্ধ চলছে। হোটেলের বাইরে পা ফেলা মানা। চারদিক নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে সাঁজোয়া গাড়ির ছুটে যাওয়ার শব্দ। দুশ্চিন্তা ও খেদের সঙ্গে সুজিতবাবু বলছিলেন, ‘আপাতত নিরাপদ রয়েছি। কিন্তু আমরা সবাই আতঙ্কিত। জীবনে প্রথমবার কাশ্মীর ঘুরতে এসেছিলাম। সেই ঘোরা শেষ না করেই ফিরতে হচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে, ওই সময় আমরাও তো পহেলগাঁওতে থাকতে পারতাম!’ উলুবেড়িয়ার লকগেটপাড়ার বাসিন্দা গোপাল ঘোষাল ও তাঁর পরিবার আরও অনেকের সঙ্গে কাশ্মীর ঘুরতে গিয়েছেন। গোপালবাবু ফোনে বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুরে আমাদের পহেলগাঁও পৌছনোর কথা ছিল। কিন্তু বৈসরণে জঙ্গি হামলার পর মাঝপথে, পহেলগাঁও থেকে প্রায় ৫০০ মিটার আগে আমাদের আটকে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে ফিরে আসি। ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন। একরাশ আতঙ্ক বুকে নিয়ে আমরা অনন্তনাগে ফিরে আসি। রাতটা কোনওরকমে হোটেলে কাটিয়ে সকালেই কাটরার উদ্দেশে রওনা হয়েছি। শুনশান রাস্তাঘাট। দোকান-বাজার সব বন্ধ। মোড়ে মোড়ে সেনার টহল চলছে।’ বুধবার এবং বৃহস্পতিবার কাটরায় রাত কাটিয়ে শুক্রবার কলকাতা ফেরার ট্রেন ধরবেন তাঁরা। হাওড়ার ৫২ জনের একটি পর্যটক দলের সঙ্গে কাশ্মীর গিয়েছেন গোপালবাবুরা।
কাশ্মীরে এখন পর্যটনের ভরা মরশুম। উপত্যকার প্রায় সমস্ত হোটেলেই ঠাঁই নাই দশা। তবে মর্মান্তিক এই ঘটনার পরেই আমূল বদলে গিয়েছে ছবিটা। ভূস্বর্গ ছেড়ে সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে উদগ্রীব।