প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া
‘...গোলি মার দিয়া, তুমহারে ভাইয়াকো গোলি মার দিয়া।’
ফোনের ও পারে বৌদি জয়ার গলা ধরে এসেছিল কথাটা বলার সময়ে। তাতেই মণীশরঞ্জন মিশ্রর ছোট ভাই বিনীত বুঝে গিয়েছিলেন সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। কাটরা যাওয়ার পথে বুধবার বিকেলে ফোনটা এসেছিল। তখনই যাত্রা বাতিল করে ডালটনগঞ্জে নেমে ঝালদা ফিরে আসেন বিনীতরা।
বুধবার বিকেলে দক্ষিণ কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গি হামলায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন মণীশরঞ্জন তাঁদেরই একজন। কর্মসূত্রে হায়দরাবাদের বাসিন্দা হলেও তাঁর আদি বাড়ি ঝালদায়। বাংলার প্রান্তিক এই পুরশহরের পুরোনো বাঘমুন্ডি রোডে মণীশরঞ্জনের পৈতৃক বাড়ি রয়েছে। বিহারের সাসারাম থেকে কর্মসূত্রে ঝালদায় এলেও দীর্ঘদিন ধরে তাঁর পরিবার বাংলারই বাসিন্দা। বাবা মঙ্গলেশ মিশ্র ঝালদা হিন্দি হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুলেই পড়তেন মণীশ। স্কুলের শিক্ষক জগন্নাথ দাস জানান, বুধবার স্কুলে ওঁর স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
কাস্টমস বিভাগে কর্মজীবন শুরু হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরে ডিএসপি পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন মণীশ। গত ১৫ এপ্রিল দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সস্ত্রীক হায়দরাবাদ থেকে কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। বারাণসী, অযোধ্যা, দিল্লি হয়ে কাশ্মীর পৌঁছেছিলেন। মণীশ–সহ পরিবারের বাকি সদস্যেরা সবাই মিলে বৈষ্ণোদেবীতে পুজো দেবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। সেই মোতাবেক মণীশের বাকি দুই ভাই রাহুল ও বিনীত এবং তাঁদের বাবা-মা সহ পরিবারের বাকি সদস্যেরা ট্রেনে কাটরা রওনা দিয়েছিলেন। পথেই জঙ্গি হানার খবর পেয়ে বাড়ির সবাই ঝালদা ফিরে আসেন।
মঙ্গলবার গভীর রাতে মণীশের মৃত্যুর খবর ঝালদায় পৌঁছয়। বুধবার সকাল থেকেই ঝালদার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে মণীশের বাড়ি ঘিরে ছিল ইতিউতি জটলা। পাড়ার ছেলের এ ভাবে মৃত্যু পড়শিরা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। সকলেি বলছেন, জাস্টিস চাই।
ঠিক কী ঘটেছিল? মণীশের বাল্যবন্ধু মনোজ রুংটা বলেন, ‘যতটুকু শুনলাম, পহেলগামে মণীশ যখন ঘোড়ায় চলছিল, সে সময়ে জঙ্গিরা এসে ওকে গুলি করে। পাশে তখন দাঁড়িয়েছিল ওর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে। ওঁর স্ত্রী ওখানকার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।’
আর এক পড়শি মহেন্দ্র রুংটা বলেন, ‘কর্মসূত্রে বাইরে থাকলে কী হবে, ঝালদার কেউ যদি কোথাও কোনও সমস্যায় পড়ত ওঁর কাছে খবর পৌঁছলে পাশে দাঁড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করত। ১০-১২ বছর আগে ও তখন দিল্লিতে কর্মরত। দিল্লি থেকে ফেরার ট্রেন ধরতে স্টেশনে এসে আমার কাকার হার্ট অ্যাটাক হয়। আমার খুড়তুতো ভাই মণীশকে ফোন করলে ও দ্রুত স্টেশনে হাজির হয়ে কাকাকে রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে। ওঁর জন্যই কাকার পুনর্জন্ম বলতে পারেন। পরোপকারী এরকম একটি ছেলের এ ভাবে জঙ্গি হানায় মৃত্যুর পরে গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তো উঠছে।’
বুধবার ঝালদায় মণীশের বাড়িতে ফোন করেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন তিনি বলেন, ‘পুরুলিয়ার ভদ্রলোকের বাড়িতে ফোন করেছিলাম। কিন্তু ফোন কোনও কারণে ধরতে পারেননি। তাঁর দেহ রাঁচি থেকে গাঁড়িতে আসবে। প্লেনে দেহ উঠেছে সেই খবর পেয়েছি।’
এ দিন জেলা পরিষদের সভাধিপতি নিবেদিতা মাহাতো ও বাঘমুন্ডির বিধায়ক সুশান্ত মাহাতো মণীশের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। মণীশের বাড়িতে আসেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার ও পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় সিং মাহাতোও। উল্লেখ্য, মণীশের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতিবার ১২ ঘণ্টা ঝালদা বন্ধের ডাক দিয়েছে ঝালদা নাগরিক মঞ্চ।