• বিতানের কফিনবন্দি দেহ ফিরল, বাবাকেই খুঁজছে হৃদান
    এই সময় | ২৪ এপ্রিল ২০২৫
  • শ্যামগোপাল রায় ও সুপ্রকাশ মণ্ডল ■ কলকাতা

    ছোট্টটি সে। তিন বছরের জীবনে ভিড় বড় কম দেখেনি সে। কিন্তু ভিড়ের এমন ভাষা কখনও শোনেনি সে। শ্রীনগরের হাসপাতাল হোক, বা কলকাতা বিমানবন্দর— সর্বত্র ভিড় যেন তাদেরই কেন্দ্র করে। এমনকী, তার চিরপরিচিত বাড়িটাতেও কেমন অ-চেনা ভিড়। সকলেই তাকে কোলে তুলে নিচ্ছে। কিন্তু তাদের কাউকেই সে চেনে না। মা সবসময়ে কেঁদেই চলেছে। ছোট্ট হৃদান কিছুই বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যালে দৃষ্টির হৃদান যেন স্টিল ছবির ফ্রেম।

    সব ঠিক থাকলে বাবা-মায়ের সঙ্গে কাশ্মীরে বেড়িয়ে হৃদান বাড়ি ফিরত আজ, বৃহস্পতিবার। কিন্তু কিছুই আর ঠিক নেই। তাই ফিরতে হলো এক দিন আগে, বুধবার রাতেই। হৃদানের বাবা বিতান অধিকারী (৪০) ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে। কফিনের সঙ্গী হলেন বিতানের স্ত্রী সোহিনী রায় অধিকারী। মঙ্গলবার দুপুরে কাশ্মীরের বৈসরন ভ্যালিতে জঙ্গিদের গুলি চিরতরে ‘ছুটি’ করে দিয়েছে বিতানের। বুধবার রাত ৯টা বেজে ৬মিনিটে কলকাতা পুরসভার শববাহী গাড়িতে মরদেহ ফেরে সোহিনীদের বৈষ্ণবনগরের বাড়িতে। ওই গাড়িতেই ছিলেন সোহিনী, হৃদান। তাঁদের বাড়ির সামনের ছোট্ট গলিটাতে তখন ভিড়ে ভিড়াক্কার।

    রাত আটটা নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছয় বিতানের দেহ। বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির অগ্নিমিত্রা পল, রুদ্রনীল ঘোষ-সহ অনেকেই। সেখানে সোহিনী শুভেন্দু অধিকারীকে বলেন, ‘আমার ছেলের চোখের সামনেই ওর বাবাকে মেরে ফেলল। আমি আপনার ভরসাতেই এসেছি। ও আপনাকে খুব মানত।’ শুভেন্দু বলেন, ‘রাজনীতির কথা বাদ দিন। আমরা মোদীর শিষ্য, এর বদলা নেব।’

    মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় পুলিশ বিতানের বাড়িতে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে দেয়। দক্ষিণ কলকাতার বৈষ্ণবঘাটার বাড়িতে রয়েছেন বিতানের মামাতো দাদা দীপক চক্রবর্তী। খবর পাওয়ার পরেই পাগলের মতো কাঁদছিলেন তিনি। বিতান-সোহিনীর ছেলে হৃদান অকৃতদার দীপকের প্রাণ। আদতে দুর্গাপুরের বাসিন্দা হলেও থাকতেন এই বৈষ্ণবঘাটার বাড়িতেই। সোহিনীদের দেখভাল তিনিই করতেন। স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়েছিল হৃদান। মঙ্গলবার বেশি রাতের দিকে ফোনে সোহিনীর সঙ্গে কথা হয় দীপকের। দু’জনেই অঝোরে কেঁদেছেন। কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন। সোহিনী বারবার একটাই কথা বলেছেন— তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরতে চাই।’

    বিতানেরা আদতে পশ্চিম বর্ধমানের দু্র্গাপুরের বাসিন্দা। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে স্টিল টাউনশিপের এ-জোনের সেকেন্ডারি রোডে। এখানকার শিবাজি বয়েজ় স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। তার পরে ফুলঝোড় এলাকার এক বেসরকারি কলেজ থেকে ইনফরমেশন টেকনলজি নিয়ে বিটেক করেন। পাশ করেই নামজাদা আইটি সংস্থায় যোগ দেন। বিতানের বাবা বীরেশ্বর অধিকারী দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টে ‘হুইল অ্যান্ড অ্যাক্সেল’ বিভাগে চাকরি করতেন। অবসরের পর ২০০৮ সালে দুর্গাপুর থেকে কলকাতার বেহালায় চলে যান বিতানরা। সেখানেই বাড়ি করেন। বছর আটেক আগে বিয়ের পরে সোহিনীকে িনয়ে ফ্লরিডায় চলে যান বিতান। সোহিনী সেখানে চাকরি করতেন। সেখানেই হৃদানের জন্ম। বছর দুয়েক আগে ছোট্ট হৃদানকে নিয়ে দেশে ফেরেন সোহিনী। বিতান ফ্লরিডাতেই ছিলেন। গত ৮ এপ্রিল কলকাতায় ফিরেছিলেন তিনি। ১৬ তারিখ সপরিবার কাশ্মীর রওনা হয়েছিলেন।

    বিতানের বাবা বীরেশ্বরবাবুর বয়স ৮৭। সম্প্রতি পেসমেকার বসেছে। বুধবার সকালে পুত্রের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয় তাঁকে। তার পর থেকে সমানে কেঁদেই চলেছেন তিনি এবং বিতানের মা মায়া অধিকারী। তাঁর বাবা বলেন, ‘আমাদের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চেয়েছিল। আমি বললাম, বৌমাকে নিয়ে ঘুরে আয়। প্রতি দিন ফোনে কথা হত।’ বিতানের মা বলেন, ‘নববর্ষের দিন ভিডিয়ো কল করে অনেকক্ষণ কথা বলল। বিশ্বাস করতে পারছি না, ও আর নেই।’ আমেরিকায় থিতু হলেও দুর্গাপুরের স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগোযোগ ছিল। বিতানের মৃত্যুর খবর পেয়ে বুধবার সকালে বাল্যবন্ধুদের অনেকেই স্কুলে এসেছিলেন। বিতানের এক বন্ধু বিশ্বজিৎ বর্মন বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে টিভিতে বিতানের মৃত্যুর খবর দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। ২০২১ সালে শেষ দুর্গাপুরে এসেছিল। এ বার ফ্লরিডা থেকে আসার আগে ফোনে কথা হয়েছিল। বলেছিল, কাশ্মীর থেকে কলকাতায় ফিরে দুর্গাপুরে আসবে।’ এ দিন রাতে বিতানের দুর্গাপুরের বন্ধুদের অনেকেই বৈষ্ণবনগরে এসেছিলেন তাঁদের বন্ধুকে শেষ দেখা দেখতে।

  • Link to this news (এই সময়)