• জঙ্গিদের হাত থেকে আগেও রক্ষা ঝন্টুর
    বর্তমান | ২৫ এপ্রিল ২০২৫
  • সৌরভ ভট্টাচার্য, তেহট্ট: ‘ছুটিতে বাড়ি এলে চুপচাপ বসে থাকত না। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে নেমে পড়ত ফুটবল খেলতে। বাড়িতে যে ক’দিন থাকত হইহই করে কাটাত। আমার সেই ছেলেবেলার বন্ধুকে আর দেখতে পাব না!’  বৃহস্পতিবার ঝন্টু আলি শেখের বাড়ির সামনে চোখে ডলতে ডলতে কথাগুলো বলছিলেন বন্ধু সমিরুল শেখ। পহেলগাঁওয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর পাল্টা এনকাউন্টারে নেমেছে সেনাবাহিনী। সেই দলে ছিলেন তেহট্টের পাথরঘাটা গ্রামের তরতাজা যুবক। বুক চিতিয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে মোকাবিলা করছিলেন। কিন্তু, মাঝপথে জঙ্গিদের গুলি তাঁকে ঝাঁঝরা করে দেয়। বন্ধুর শহিদ হওয়ার খবর পেয়েই বাড়িতে চলে আসেন সমিরুল। বলছিলেন, ‘ও ছুটিতে এলে আমার দোকানেই বসত। সেখানে আমরা ক’জন বন্ধু মিলে ওর কর্মজীবনের  অভিজ্ঞতা শুনতাম। মুগ্ধ হয়ে যেতাম। এখন আর কে শোনাবে সেই গল্প।’ 

    পাথরঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাস করেছিলেন ঝন্টু। বড় আন্দুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক। ২০০৮ সালে বেতাই ডঃ বি আর আম্বেদকর কলেজে ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন তিনি। ওই বছরই সেনা বাহিনীতে চাকরি পেয়ে যান। প্রায় ১৭ বছর চাকরি জীবন। সমিরুল বলছিলেন, ‘ওর মুখে কত অভিজ্ঞতার গল্প আমরা শুনেছি। একবার ওই কাশ্মীরেই জঙ্গি হামলার মুখে পড়েও বেঁচে গিয়েছিল আমাদের ঝন্টু। সেই হাড়হিম করা কাহিনি শুনিয়েছিল আমাদের—রাতে ডিউটি সেরে শিবিরে ঘুমোতে এসেছে। বিছানা করে শুতে যাবে, এমন সময় এক সহযোদ্ধা এসে ওই বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। অগত্যা অন্য বিছানায় যেতে হয় ঝন্টুকে। সেই রাতে শিবিরে জঙ্গিরা হামলা চালায়। ওই সহকর্মী গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান। বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছিল ঝন্টু। বাড়িতে উড়ো খবর আসে ও মারা গিয়েছে। এ ধরনের অনেক গল্প শুনতে আমরা মুখিয়ে থাকতাম। কবে ঝন্টু ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবে। ও যে এভাবে চিরতরে ছুটি নিয়ে চলে যাবে ভাবতেই পারছি না!’ 

    পড়শি সাহাবুদ্দিন মণ্ডল একদা সেনা বাহিনীতে ছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘ছোটবেলা থেকে ওরা তিন ভাই দেশ সেবায় সেনা বাহিনীতে কাজ করবে বলে স্বপ্ন দেখত। আমাকেও বলত। সেই কারণেই ছোট থেকে দৌড়, খেলাধুলো সহ শারীরিক কসরত করত। ওর দাদা রফিকুল প্রথমে সেনা বাহিনীতে চাকরি পায়। এখন সে সুবেদার পোস্টে কাশ্মীরে কর্মরত। তাঁকে দেখেই আরও উৎসাহ পেয়ে গিয়েছিল ঝন্টু। জোর কদমে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য পরিশ্রম শুরু করে। ২০০৮ সালে চাকরি পায়। বড্ড ভালো ছেলে ছিল ঝন্টু। ছুটিতে এলেই সকলের সঙ্গে কথা বলত। গ্রামের তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উৎসাহিত করত।’ 

    ঝণ্টুর শহিদ হওয়ার খবর পেয়ে মুষড়ে পড়েছেন তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি বলছিলেন, ‘প্রাথমিকে পড়ার সময় থেকেই ও সেনাবাহিনীতে চাকরি করবে বলত। তখন থেকে মাঠে দৌড়াত, খেলাধুলো করত। গ্রামে সবার সঙ্গেই ওর সুসম্পর্ক। ছুটিতে এলে আমার সঙ্গে দেখা হলে অনেক কথা বলত। শরীরের প্রতি নজর রাখতে বলত। স্কুলে সব শিক্ষককে  ও সম্মান করত। আমাদের সেই ছোট্ট ঝন্টু আজ শহিদ! খুব গর্ববোধ হচ্ছে। শুধু ওর হাসি মুখ খানা দেখতে পাব না ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে। -নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)