সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায় ও প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া
মাথার উপরে বৈশাখের গনগনে রোদ। প্রায় সাড়ে ৪১ ডিগ্রির দুপুরে ঝালদা শহরের প্রান্তে জোট বেঁধে কয়েকশো মানুষ। কারও হাতে, কারও মোটরবাইকের সামনে লাগানো জাতীয় পতাকা। পরনে সাদা ধবধবে টি-শার্ট, লেখা ‘মণীশরঞ্জন অমর রহে’।
কাশ্মীরে জঙ্গি হানায় নিহত মণীশরঞ্জন মিশ্রর কফিনবন্দি দেহ যে সকালেই রাঁচি পৌঁছে গিয়েছে এই খবর ঝালদায় পৌঁছতে ভিড় আরও বাড়তে থাকে। ঘরের ছেলেকে শেষবারের মতো দেখতে চান সকলে। রাঁচিতে সিআরপিএফ ক্যাম্পে গার্ড অফ অনারের পরে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে শববাহী শকট যখন ঝালদার প্রান্তে থামল, ঘড়ির কাঁটায় তখন সাড়ে ১২টা।
‘মণীশরঞ্জন অমর রহে’, ‘মণীশ ভাইয়া অমর রহে’— স্লোগানে ঝালদায় স্থানীয় নাগরিক মঞ্চের ডাকে বন্ধের নিস্তব্ধতা কেটে যায় মুহূর্তে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কনভয় এসে থামল জালান রোডে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর ডিএসপি পদমর্যাদার আধিকারিক মণীশরঞ্জনের বাড়ির বাইরে। পারিবারিক বন্ধু ও স্বজনদের সঙ্গে নিজের কাঁধে মণীশরঞ্জনের কফিন তুলে বাড়ির উঠোনে রাখলেন পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিহত আইবি অফিসারের স্ত্রী জয়া জ্ঞান হারালে তাঁকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের বছর পাঁচেকের মেয়ে যিশুকে কেউ কোলে তুলে নেন। মুখে আঙুল ঢুকিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে সকলকে দেখছিল সে। ‘পাপা, পাপা’ বলে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে কফিনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে মণীশ-জয়ার বছর ১২–র ছেলে সমৃদ্ধ।
কফিন ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাবাকে তোলার মরিয়া চেষ্টা দেখে পুলিশ সুপার নিজেই কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে সমৃদ্ধকে সরিয়ে নিয়ে যান। মণীশের মা আশাদেবী এসে শেষবার দেখার চেষ্টা করলেন ছেলের মুখ। তাঁকেও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
মাঝ দুপুরে শ্মশানঘাট মায়া সরোবরের উদ্দেশে শুরু হয় শেষযাত্রা। শববাহী গাড়ির সামনে প্রায় ৪০ ফুটের জাতীয় পতাকা কাঁধে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ। মিশন রোড, বীরসা মোড়, রাঁচি রোড হয়ে যাত্রা যত এগিয়েছে দু’পাশে বেড়েছে মানুষের ভিড়। কতদিন পরে এই জনপদ এই দৃশ্যের সাক্ষী হলো, মনে করতে পারেননি মণীশের বাল্যবন্ধু মনোজ রুংতা।
ছলছল চোখে তিনি বলছিলেন, ‘এ ভাবে যে ওকে শেষ বিদায় দিতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।’ মণীশের মেজো ভাই রাহুল বলেন, ‘কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে দাদাকে সন্ত্রাসবাদের শিকার হতে হলো। কবে এর শেষ হবে বলতে পারেন? না-হলে যে আমরা দাদাকে হারাতাম না।’
মণীশরঞ্জন তাঁর শেষযাত্রায় সব রাজনৈতিক দলকেই মিলিয়ে দিয়ে গেলেন ঝালদার রাজপথে। সামিল হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার, পুরুলিয়ার বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো, জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়া, বিধায়ক সুশান্ত মাহাতো। ছিলেন পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি নিবেদিতা মাহাতো, সহ সভাধিপতি সুজয় বন্দোপাধ্যায়, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো ও জেলা কংগ্রেস সভাপতি, ঝালদার বাসিন্দা নেপাল মাহাতোও।
শ্মশানে মণীশরঞ্জনকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হয়। ছোট ভাই বিনীত মুখাগ্নি করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দাদাকে এ ভাবে হারাতে হবে ভাবিনি।’ ঝালদার একটি রাস্তা মণীশের নামে রাখার দাবি উঠছে। শবযাত্রার সামনে ব্যানারে লেখা, ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো, এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।’