• দর্শক টানতেই কি সমাজমাধ্যমে ছড়াচ্ছে পশু নির্যাতনের ভিডিয়ো
    আনন্দবাজার | ২৫ এপ্রিল ২০২৫
  • কোনওটিতে রাস্তায় পড়ে ছটফট করতে দেখা যাচ্ছে একটি কুকুরশাবককে। ঘিরে ধরে সেটিকে বেধড়ক লাঠিপেটা করছেন কয়েক জন। যন্ত্রণায় শাবকটির চিৎকার যত বাড়ছে, আঘাত ততই জোরালো হচ্ছে। মাথা দু’টুকরো করে না দেওয়া পর্যন্ত চলেছে লাঠির ঘা! কোনওটিতে আবার একটি কুকুরের মুখে বস্তা পেঁচিয়ে চার দিক থেকে পা টেনে ধরতে দেখা যাচ্ছে কয়েক জনকে। সেই অবস্থায় পায়ের নখ উপড়ে নেওয়া হচ্ছে কুকুরটির। যন্ত্রণায় চিৎকার করে এক সময়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। এমনও ভিডিয়ো দেখা যাচ্ছে, যেখানে একটি হস্তিশাবককে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে জ্বলন্ত চুল্লির উপরে। সেই অবস্থায় গরম শিক ঢোকানো হচ্ছে শাবকটির শরীরের নানা জায়গায়। সেই সঙ্গেই চলছে নির্যাতনের ভিডিয়ো তুলে রাখার উল্লাস!

    এই মুহূর্তে এমন নানা দৃশ্য ঘুরছে সমাজমাধ্যমে। অনেকের দাবি, সরাসরি সেই সব ভিডিয়ো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পশুপ্রেমী ও পশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সমাজমাধ্যমের গ্রুপ ও ‘পেজ’-এ। সেগুলি দেখে ‘রিপোর্ট’ করলেও বন্ধ হওয়ার বদলে এমন ভিডিয়ো আসা বেড়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, এমন সব দৃশ্য ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কী? সাহায্য চাওয়ার ব্যাপার, না কি লাইক, কমেন্ট, ভিউ বা ফলোয়ার বাড়ানোর খেলা? মনোরোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এমন ভিডিয়োর কুপ্রভাব পড়ছে। বিশেষত, মানসিক ভাবে
    স্পর্শকাতর জায়গায় রয়েছেন যাঁরা, এমন দৃশ্য তাঁদের উপরে খারাপ প্রভাব ফেলছে।

    মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘সহজে প্রচার পাওয়ার চেষ্টায় অনেকেই অনেক কিছু নির্দ্বিধায় ছড়িয়ে দেন। কোনও ছাঁকনি নেই সমাজমাধ্যমে। বয়স্ক থেকে শিশুদের মধ্যে এ সবের কুপ্রভাব পড়ছে বেশি।
    অনেকে এমন ভিডিয়ো দেখে ভাবতে শুরু করেন, তেমন শাস্তি তো হয় না। আমরাও তাই করতে পারি।’’ মনোরোগ চিকিৎসক দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘যে কোনও হিংসাকেই ছড়িয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। এমন ঘটনা প্রচারও পায় সহজেই। পশুর প্রতি ভালবাসা দেখানোর জন্য অত্যাচার দেখানোর প্রয়োজন নেই। সহমর্মিতা তৈরির বদলে বহু ক্ষেত্রেই এমন ভিডিয়ো বিকৃতি ছড়ায়।’’

    পশু চিকিৎসক শতদ্রু সরকার বলেন, ‘‘একটি বিজ্ঞান পত্রিকায় পড়েছিলাম, হুবহু লেখা ছিল, ‘মাথা কেটে নেওয়ার পর আরশোলা কত ক্ষণ বাঁচে? উত্তর: নয় দিন (কথাটা বিশ্বাস করে নিন, যাচাই করতে যাবেন না)’। যাতে এই তথ্য পেয়ে অনেকেই আরশোলার মতো প্রাণীর মুণ্ডচ্ছেদের পরীক্ষা করে দেখতে ব্যস্ত হয়ে না ওঠেন। আসলে বহু ক্ষেত্রেই মজ্জাগত নিষ্ঠুরতাকে সত্তার অঙ্গ হিসেবে বহন করার প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রবণতা থেকেই নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির ভিডিয়ো প্রচার চলছে।’’ কিন্তু এমন ক্ষেত্রে সমাজমাধ্যম গ্রুপ ও পেজ-এর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি (অ্যাডমিন) নিয়ন্ত্রণ করেন না কেন?

    অভিযোগ, এমন ভিডিয়ো যে হেতু প্রচুর মানুষ দেখেন, তাই একটি পেজ ও গ্রুপে প্রচুর সদস্য টেনে আনতে পারে। ফলে বহু ক্ষেত্রে বুঝেই ছাড় দেওয়া হয়। পশু চিকিৎসক অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘সত্যিই যদি কেউ সাহায্য চেয়ে কোনও পোস্ট করেন, তাঁকে স্বাগত। এমন পোস্টে ভাল হয় বলেই বিশ্বাস করি। কিন্তু যদি অন্য কোনও স্বার্থে এমন ভিডিয়ো ছড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের। তা হলে সেটা দ্রুত সরিয়ে ফেলার দায়িত্ব অ্যাডমিনকে নিতে হবে।’’

    শুধুই কি দায়িত্ব পালন? আইনি পথ নেই? ‘পিপল ফর এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অব অ্যানিম্যাল’ বা পেটা-র তরফে আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, এক সময়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির একটি ধারায় পশুর দামের উপরে ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট পশু অত্যাচারের শাস্তি নির্ধারিত হত। এখন সেই জায়গায় এসেছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার (বিএনএস) ৩২৫ ধারা। আর আছে প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ আইন, ১৯৬০ (প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস অ্যাক্ট)। বিএনএস শাস্তি এবং জরিমানা বাড়ালেও পশুর উপর যৌন নির্যাতন-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেনি। সেখানে পশু নির্যাতনের ভিডিয়ো নিয়ে ভাবনা কোথায়?
  • Link to this news (আনন্দবাজার)