• অনুব্রতকে জেলে পাঠানো বিচারক রাজেশের বদলি
    এই সময় | ২৬ এপ্রিল ২০২৫
  • সুশান্ত বণিক, আসানসোল

    রাজ্য রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় দু’টি বিষয় প্রকাশ্যে চলে এসেছে। একটি গোরু পাচার এবং দ্বিতীয় কয়লা চুরি। যা নিয়ে শুধু রাজ্যস্তরেই নয়, তা নিয়ে সংসদেও সরব হয়েছেন বিরোধীরা।

    ঘটনা হলো, এই দু’টি বিষয় নিয়ে মামলা উঠেছিল আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে। দীর্ঘমেয়াদি শুনানির পরে বলিষ্ঠ ভাবেই রায় দিয়েছেন বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী। যার জন্য বহুবার তাঁর কাছে এসেছে হুমকি–চিঠি। কিন্তু দমে যাননি অকুতোভয় বিচারক। শুক্রবার আসানসোল থেকে তিনি বদলি হলেন কলকাতার আলিপুর আদালতে।

    ২০২১ সালের নভেম্বরে আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে বিচারক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন রাজেশ। সিবিআই–এর দায়ের করা গোরু ও কয়লা চুরি সংক্রান্ত মামলা ওঠে এই আদালতেই। ২০২২ সালের ১১ অগস্ট গোরু পাচার মামলার মূল অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই। বীরভূম থেকে সরাসরি জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রতকে এই আদালতেই তোলা হয়। বিচারপতি রাজেশ তাঁকে সিবিআই হেফাজতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সিবিআই জেরার পরে ২৪ অগস্ট ফের অনুব্রতকে আদালতে তোলে।

    সেই সময়ে অনুব্রতের হয়ে কলকাতা হাইকোর্ট–সহ রাজ্যের নানা আদালত থেকে ৫০ জন আইনজীবী সওয়াল করেছিলেন। দু’পক্ষের শুনানি শোনার পরে বিচারক রাজেশ বীরভূমের তৃণমূল নেতাকে আসানসোলের বিশেষ সংশোধানাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে বহু বার অনুব্রতকে আদালতে তোলা হলেও তাঁকে জামিন দেননি বিচারক। তাঁর উপরে চাপ তৈরি করতে বহুবার হুমকি চিঠিও পাঠানো হয়। এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারও করেছিল পুলিশ।

    আসানসোলে মামলা চলাকালীন অনুব্রতকে সংশোধানাগারে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বিচারক সেই অনুমতিও দেন। পরে ইডি দিল্লি সিটি রাউস অ্যাভিনিউ আদালতে অনুব্রতর বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই আদালতের নির্দেশে অনুব্রতকে ২০২৩ সালের ২ মার্চ দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত অনুব্রতর জেল হাজতের নির্দেশ দেওয়ায় অনুব্রতর ঠাঁই হয় তিহার জেলে। সিবিআইও পরে অনুব্রতর মামলা দিল্লির সিটি রাউস অ্যাভিনিউ আদালতে নিয়ে যায়।

    সিবিআই–এর দায়ের করা কয়লা চুরির মামলাতেও কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন বিচারক রাজেশ। দিনের পর দিন শুনানি করেছেন তিনি। চুরিতে অভিযুক্ত একাধিক কয়লা মাফিয়া–সহ ইসিএলের তাবড় অফিসার, খোদ প্রাক্তন সিএমডি নিরাপত্তা আধিকারিকদের জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কয়লা চুরি মামলার মূল অভিযুক্ত অনুপ মাজি ওরফে লালা গ্রেপ্তারি এড়াতে সুপ্রিম কোর্টের রক্ষাকবচ পেয়েছিলেন। কিন্তু বিচারকের নির্দেশে লালাকে মামলার শুনানিতে প্রতিদিনই আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে হাজির হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দু’বছর ধরে শুনানি চলার পরে চার্জশিট জমা পড়ে আদালতে। অভিযুক্ত হন ৪৯ জন।

    এমন বলিষ্ঠ প্রকৃতির বিচারকের এই বদলি রুটিনমাফিক হলেও রাজেশ চক্রবর্তীর অনমনীয় মনোভাব প্রভাব ফেলেছে আইনজীবী মহলে। আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে কয়লা ও গোরু চুরি মামলায় অভিযুক্তদের হয়ে সওয়াল করেছিলেন দুই আইনজীবী। তাঁদের অন্যতম শেখর কুণ্ডু বলেন, ‘ব্যক্তি হিসেবে তিনি অসাধারণ। আইনের ব্যাখ্যায় কোনও ত্রুটি খুঁজে পাইনি। এখনও পর্যন্ত যে ক’জন বিচারকের সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁদের মধ্যে রাজেশ চক্রবর্তী সবচেয়ে ভালো।’

    অন্য এক আইনজীবী সোমনাথ চট্টরাজের কথায়, ‘আইনজীবীদের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো ছিল। সওয়াল–জবাবের সময়ে খুব সহোযগিতা করতেন। ওঁর সঙ্গে কাজ করে খুব আনন্দ পেয়েছি। বিচার প্রক্রিয়ার সময়ে তাঁর দৃঢ়তা মুগ্ধ করেছে। আশা করি, নতুন জায়গাতেও তিনি এই ধারা বজায় রাখবেন।’ আসানসোল বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বাণী মণ্ডলের মন্তব্য, ‘বিচারক হিসেবে তাঁর বিষয়ে কিছু বলা যায় না। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আইনজীবীদের সঙ্গে খুবই সহযোগিতা করতেন।’

    তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক ভি শিবদাসনের মন্তব্য, ‘বিচারকদের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা সমীচীন নয়। তবে উনি দক্ষতার সঙ্গেই বিচার প্রক্রিয়া জারি রেখেছিলেন। যেখানে বদলি হয়ে যাচ্ছেন, আশা করি সেখানেও তার অন্যথা হবে না।’

  • Link to this news (এই সময়)