• ‘রঙরেজ়া’ হজরতের রঙিন সুতোয় সাজে জপমালার থলি, বাংলাতেই রয়েছে সে গ্রাম
    এই সময় | ২৭ এপ্রিল ২০২৫
  • এ যেন অনেকটা ‘কুন ফায়াকুন’-এর লিরিক্স। যেখানে ‘রঙরেজ়া’র উদ্দেশে বলা হচ্ছে: ‘রঙ মেরা তন, মেরা মন’। অর্থাৎ ‘রাঙিয়ে দাও আমার শরীর, আমার মন’। কিন্তু কে এই ‘রঙরেজ়া’ বা রঙের কারিগর, যাঁর হাতের তৈরি জপমালা এক করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক গ্রামের হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মাবলম্বীর হাত? তিনি হজরত মণ্ডল।

    এক সময় দিল্লিতে কাজ করতেন পূর্ব বর্ধমানের কালনার সিংহজুলির ছেলে হজরত। সেখানেই এমব্রয়ডারির কাজ শিখেছিলেন। পরে দিল্লি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন। আবার যেন সেই ‘কুন ফায়াকুন’: ‘কদম বড়হা লে/হদো কো মিটা লে (পা বাড়িয়ে দাও/দূরত্ব দূর করে দাও)’। কালনার সিংহজুলি গ্রাম যেন ডেকে উঠেছিল হজরতকে: ‘পা বাড়িয়ে দাও/দূরত্ব দূর করে দাও।’ গ্রামের ছেলে আবার গ্রামেই ফিরে আসুক। এখন সেই গ্রামে বসেই কাপড় আর সুতোর যুগলবন্দিতে হজরত তৈরি করেন জপমালার থলি।

    সেই থলির কোনওটায় ফুটিয়ে তোলেন শ্রীকৃষ্ণের মুখ, কোনওটায় আবার চৈতন্যের ছবি। আর হজরতের হাতের স্পর্শে তৈরি সেই জপমালায় ইষ্টনাম জপ করেন হিন্দু ভক্তরা। এ-ও তো সেই ‘কদম বড়হা লে/হদো কো মিটা লে’-রই মতো... যেখানে দুই ভিন্ন ধর্মের ফারাক বা দূরত্ব ঘুচিয়ে একাত্মা হয়ে যেতে বলা হচ্ছে।

    এক-দু’বছর নয়, গত ১৫ বছর ধরে জপের থলি তৈরি করে আসছে ‘রঙরেজ়া’ হজরতের পরিবার। প্রথমে একা হাতে স-অ-অ-অ-ব-টা করতেন হজরত। পরে তাঁর হাত শক্ত করেন স্ত্রীও। ধীরে ধীরে গ্রামের বহু মুসলিম মহিলা এই জপমালার থলি তৈরিতে হাত লাগান। এই জপমালার থলি বিক্রি হয় দোকানে। তা স্বনির্ভর করে তোলে গ্রামের রুপিয়া, আনোয়ারা, শাহানারা, রুনাদের।

    হজরত জানান, দিল্লিতে বেশ কিছু দিন এমব্রয়ডারির কাজ করেছিলেন। পরে কালনার বাড়িতে ফিরে মায়াপুরের ইসকনের এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেই মানুষই তাঁর জীবনে নতুন আলো নিয়ে আসেন। কৃষ্ণের জপমালার থলি তৈরির বরাত দেন তিনি। সেই থেকেই এই কাজ করে চলেছেন তিনি।

    হজরত গ্রামের মহিলাদের এই কাজ শিখিয়েছেন। ১৫-১৬ জন মহিলা সে কাজ শিখে আর্থিক উপার্জনও করছেন। শুধু মুসলিম মহিলারাই নন, গ্রামের হিন্দু মহিলারাও হজরতের কাছ থেকে শিখেছেন রঙিন সুতোয় কী ভাবে স্বপ্নের নকশা বুনতে হয়। হজরত জানান, মায়াপুরে এই জপমালার চাহিদা বেশি। তাই তিনিও প্রতিনিয়ত উৎসাহের সঙ্গে তা তৈরি করে চলেছেন।

    স্থানীয় বাসিন্দা রিনা দেবনাথের কথায়, ‘কৃষ্ণের জপমালার থলির কাজে আমরাও হাত লাগাই। আসলে কালনা, নদিয়ায় এই সংস্কৃতি আজকের নয়। হজরত মণ্ডলের কাছে কাজ শিখে আমাদেরও খুবই ভালো লাগে। এ গ্রামে আমরা একটা পরিবার। সুখে-দুঃখে সকলে মিলেমিশে থাকি। তাই বোধহয় এ কাজও আমরা সকলে মিলে এত ভালো ভাবে করতে পারি।’

    রিনার কথায় যেন একাত্ম হয়ে যায় ‘কর্মযোগ’-এর বাণী আর ‘কুন ফায়াকুন’-এর লিরিক্স। আর সেই সঙ্গে মিশে যায় সব ভেদাভেদ, তথাকথিত বৈরিতা: ‘ঈশ্বর-আল্লাহ তেরে নাম, সবকো সম্মতি দে ভগবান।’

  • Link to this news (এই সময়)