এই সময়, বহরমপুর: বাগুইআটিতে ট্রলিব্যাগের মধ্যে ৩২ বছরের তরুণী রিয়া ধরের দেহ উদ্ধারের ঘটনার তদন্তে এ বার নতুন মোড়। পুলিশ প্রথমে জানিয়েছিল, প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার গয়না হাতানোই উদ্দেশ্য ছিল কৌশিক প্রামাণিকের, যাকে অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু শনিবার নবগ্রাম থানা সূত্রে সামনে এলো এমন কিছু তথ্য, যা তদন্তকারীদের বক্তব্য অনুযায়ী, রোমহর্ষক। পুলিশ সূত্রের খবর, অভিযুক্ত কৌশিকের দাবি অনুযায়ী, সে নিজেই গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার— তার কাছ থেকে ফ্ল্যাট, বাড়ি এ সব হাতানোর লক্ষ্যেই পাতা হয়েছিল ফাঁদ, যাতে সামিল ছিল রিয়াও।
গত মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল সকালে বাগুইআটির দেশবন্ধু নগরের একটি নর্দমায় রিয়ার দেহ উদ্ধার হয় কালো রংয়ের একটি ট্রলিব্যাগের মধ্যে।
রিয়ার আসল নাম আজমিরা খাতুন। তাঁর বাড়ি মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার সুজাপুরে। ২০১৪–সালে তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় নবগ্রামের অমিতের। ২০২১ সালে মাম্পি ওরফে মাম দত্তের সঙ্গে বিয়ে হয় কৌশিকের। বিয়ের আগে কৌশিক বাগুইআটির দেশবন্ধু নগরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকত। বিয়ের পর বারাসতে প্রায় দু’কোটি টাকার ফ্ল্যাট কিনে স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে চলে যায় মার্চেন্ট নেভি–তে কর্মরত কৌশিক। পুলিশকে সে জানিয়েছে, বিয়ের আগে থেকেই অমিতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মাম্পির। কিন্তু সেটা সে প্রথমে বুঝতে পারেনি। কর্মসূত্রে পণ্যবাহী জাহাজ নিয়ে বিভিন্ন দেশে যেতে হতো কৌশিককে। বছরের প্রায় ১০ মাসই সে বাইরে থাকত। তবে জাহাজে থাকার সময়ে কৌশিকের কাছে ছিল স্যাটেলাইট ডিভাইস। যার সাহায্যে সে জানতে পারত, ফ্ল্যাটে কে ঢুকল, কে বেরলো— এ সবের সবিস্তার তথ্য। ওই ডিভাইসের মাধ্যমেই অমিতকে বারাসতের ফ্ল্যাটে যেতে এবং থাকতে সে দেখেছে বলে পুলিশি জেরায় কৌশিক দাবি করেছে। তার আরও দাবি, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন, বিচ্ছেদ, আদালতে খোরপোষ চেয়ে মাম্পির মামলা দায়ের— এ সব কিছুর নেপথ্যে আছে গভীর ষড়যন্ত্র।
পুলিশকে কৌশিক জানিয়েছে, একদিন টাকাপয়সা ও গয়নাগাটি নিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যান মাম্পি। আপাতত মধ্যমগ্রামে বাপের বাড়িতেই তিনি আছেন। তাকে মাম্পির ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রতিশোধ নিতে কৌশিক ফেসবুকে ২০২২ সালে অমিতের স্ত্রী রিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায়। তার পর বেশ কয়েক বার রিয়া কলকাতায় এসে কৌশিকের সঙ্গে দেখা করেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি হলদিয়ার এক হোটেলে ঘণ্টা তিনেক সময় কাটে যুগলের। তার পর, ২ এপ্রিল নবগ্রামে স্বামী অমিতের বাড়ি ছেড়ে কৌশিকের বারাসতের ফ্ল্যাটে ওঠেন রিয়া। কালীঘাটে ৪ এপ্রিল রিয়াকে বিয়েও করে কৌশিক। এবং কৌশিকের পরামর্শেই রিয়া বারাসত আদালতে গত ৮ এপ্রিল ডিভোর্সের মামলা করেন।
পুলিশি জেরায় কৌশিক জানিয়েছে, অমিতের কারণে তার বিবাহিত জীবন তছনছ হয়ে যাওয়ায় প্রথমে বদলা নিতেই সে রিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল। পরে সে অবশ্য রিয়াকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলে এবং তাঁকে বিয়ে করে। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎই একদিন রিয়ার সঙ্গে মাম্পির হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট কৌশিক দেখে ফেলে। কৌশিকের দাবি অনুযায়ী, সেই চ্যাটে মাম্পি লেখেন— মুম্বইয়ের আন্ধেরিতে কৌশিকের নামে প্রায় ৮ কোটি টাকার যে ফ্ল্যাট রয়েছে, তা ব্ল্যাকমেল করে আদায় করতে হবে। পাশাপাশি, কোন ব্যাঙ্কে কৌশিকের কত টাকা আছে, তা–ও রিয়াকে জানান মাম্পি। ওই হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের সূত্রেই কৌশিক বুঝতে পারে যে, বদলার ছক কষলেও সে নিজেই গভীর এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পড়েছে।
কৌশিকের অভিযোগ, বিয়ের কিছু দিন পর রিয়া নিজের নামে একটি ফ্ল্যাট কেনার দাবি জানাতে থাকেন। সেই মতো ২৫ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাটও বুক করে কৌশিক। কিন্তু ২১ এপ্রিল সন্ধ্যায় অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা দায়ের করার হুমকি দেন রিয়া। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে গোলমাল বাধে। রিয়া তাকে মারধর করে বলে কৌশিকের অভিযোগ। পুলিশের কাছে কৌশিকের দাবি, ‘আমি মার্শাল আর্ট জানি। রিয়া আমাকে মারধরের সময়ে ওর উপর মার্শাল আর্টের একটি পদ্ধতি আমি প্রয়োগ করি। তাতে সে মারা যায়।’ ওই পদ্ধতিতে গলার পিছনের অংশ হাত দিয়ে ধরে চোয়ালের দিকে হালকা চাপ দিলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে দ্রুত মৃত্যু হয়। যদিও খুনের লক্ষ্যে নয়, সাময়িক রাগের বশেই এমন কাণ্ড সে ঘটায় বলে পুলিশের কাছে কৌশিক দাবি করেছে।
অমিত অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, ‘সবটাই কৌশিকের বানানো গল্প। নিজেকে বাঁচাতে এখন ও মিথ্যে বলছে।’ বাগুইআটি থানার এক তদন্তকারী অফিসারের বক্তব্য, ‘অমিতের আচরণও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।’ তদন্তে প্রয়োজনে মাম্পিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
তা হলে গয়না হাতানোর কথা এলো কী ভাবে?
বাগুইআটি থানা প্রথমে দাবি করেছিল, ফেসবুকে কৌশিকের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর নবগ্রামের বাড়ি ছেড়ে ৩০ লক্ষ টাকার গয়না ও নগদ নিয়ে কৌশিকের বারাসতের ফ্ল্যাটে রিয়া পৌঁছন। কৌশিক ধার মেটাতে রিয়ার কাছে ওই গয়না চেয়েছিল। রিয়া রাজি না–হওয়ায় গোলমাল বাধে এবং রিয়াকে কৌশিক খুন করে। একটি সূত্রের খবর, ওই গয়না আসলে নকল ছিল। আর সে সব দিয়ে রিয়াকে কৌশিকের কাছে পাঠিয়েছিলেন অমিতই। যদিও অমিত এটাও অস্বীকার করেছেন।