এই সময়, বর্ধমান: ৮৩ বছরে প্রয়াত হলেন সাহিত্যিক, অভিনেত্রী ও শিক্ষিকা নীলা কর। বয়স হলেও নীলার মনের জোরের কাছে বার বার হার মেনেছিল নানা অসুখ। দু’দিন আগে সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়িতেই চলছিল চিকিৎসা। শনিবার বর্ধমানের বিসি বোডের কালীতলার ভাড়াবাড়িতে রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে অনুরাগীমহলে।
নীলার জন্ম উত্তরবঙ্গের বালুরঘাটে। তাঁর বাবা শিবপ্রসাদ কর নাট্যকার ও অভিনেতা হিসেবে খ্যাত ছিলেন বলে নাটক ও শিল্পচর্চার আবহেই বেড়ে ওঠা। সেই সূত্রেই নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের স্নেহদৃষ্টি পান। বালুরঘাট থেকে স্নাতক হওয়ার পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়া শুরু করেন। তার মধ্যেই বাবার মৃত্যু হতে আর বাড়ি ফেরেননি নীলা। শিক্ষকতার চাকরি শুরু করেন বর্ধমান থেকে কিছু দূরের গ্রাম বেগুট জাহ্নবী হাই স্কুলে। সেই সময়েই আকাশবাণীর নিয়মিত শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
আকাশবাণী কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হয়েছে নানা কবিতা ও শ্রুতিনাটক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি কবি, গল্পকার ও অভিনেত্রী হিসেবেও বহু সম্মান ছিল তাঁর প্রাপ্তির ঝুলিতে। সফল ভাবে নিয়মিত সম্পাদনা করেছেন ‘কোমল দূর্বা’ পত্রিকা। ‘দেশ’ পত্রিকার সুবর্ণজয়ন্তী গল্প সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে তাঁর গল্প।
নীলা করের প্রথম কবিতা সংকলন ‘সমুদ্র মন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তার পর থেকে একাধিক কবিতার বই, গদ্য ও গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখায় বারবার ফুটে উঠেছে তাঁর জীবনের নানা বিষয় ও নানা জীবন–ভাবনা। আকাশবাণীর নাট্যকার, গায়িকা নীলা করের সঙ্গে বর্ধমান সংলগ্ন এক বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের সাহিত্যপ্রেমী, সংস্কৃতি প্রেমী মানুষের এক নিবিড় সংযোগ ছিল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের থেকে ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি, সমরেশ মজুমদার, সমরেশ বসুর মতো মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র ও তাঁদের কন্যা শাঁওলি মিত্রের স্নেহধন্যা ছিলেন নীলা।
রোগজীর্ণ শরীর তুচ্ছ করে শুধু শিল্পের প্রতি ভালোবাসায় নীলা পৌঁছে যেতেন যে কোনও অনুষ্ঠানে। তাঁর ছোট্ট ঘরের মাঝে পাতা থাকত কল্পনার ভ্রমণের জন্য এক বিস্তৃর্ণ রেলপথ। তবে ইদানিং হয়তো বুঝেছিলেন, জীবনদীপ নিভে আসছে। শেষ শয্যায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া প্রত্যেককেই বলেছিলেন, শেষযাত্রায় যেন গাওয়া হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। শনিবার শ্মশানের পথে তাঁর শেষ সারস্বত যাত্রায় ‘আগুনের পরশমণি’ গাইতে গাইতে পথ চলেন অনেক অনুরাগী। সকাল থেকে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় ছিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষের।