দিগন্ত মান্না, পাঁশকুড়া
ফরাসি লেখক জ় গিয়োনোর ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত 'দ্য ম্যান হু প্লান্টেড ট্রিজ়' গল্পের মেষপালক এলজার্ড ব্যুফের কথা মনে আছে? আল্পস পর্বতমালার পাদদেশে তিনি কয়েক লক্ষ গাছ লাগিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও এলজার্ড বিচলিত না-হয়ে শুধুই গাছ লাগিয়ে যান। যা দেখে অবাক হয়ে লেখক বলেছিলেন, 'নাথিং কুড ডিস্টার্ব হিম'। এই অসময়ে সেই এলজার্ডের মতো বৃক্ষরোপণ নিয়েই ব্যস্ত পাঁশকুড়ার শচীনন্দন সামন্ত। টানা পঞ্চান্ন বছরে কোনও কিছুই তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি। প্রকৃতির ঋণ শোধ করতে মাইনে এবং পেনশনের টাকায় কার্যত সবুজ বিপ্লব ঘটিয়েছেন 'বৃক্ষমিত্র' শচীনন্দন।
পাঁশকুড়ার রাধাবল্লভচক গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পশ্চিম চিল্কার বাসিন্দা শচীনন্দন ময়নার রামচন্দ্র রাইসুদ্দিন হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ছোট থেকেই গাছ লাগানোর নেশা। ১৯৬৮ সালে স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে স্কুল চত্বরেই শুরু হয় তাঁর সবুজ অভিযান। শচীনন্দনের বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গিয়েছে নিউ কাঁসাই নদী। নদীর দুই পাড়ে সার দিয়ে মাথা তুলেছে অসংখ্য মহানিম, আম, ছাতিম, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বট, অশ্বত্থ। কোনওটার বয়স পঞ্চান্ন, কোনওটার আবার পঞ্চাশ। এ সব গাছ তাঁর লাগানো। শুধু বৃক্ষরোপণ করাই নয়, সেই গাছ সাবলম্বী না-হওয়া পর্যন্ত তিনি হাল ছাড়েন না। ওই কাজের জন্য সাত-আট জন স্থানীয় বাসিন্দাকে নিয়োগ করেছেন তিনি। প্রত্যেকের বেতন, খাওয়া খরচ- সব বহন করেন তিনি। গাছ লাগানোর ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহী করতে 'প্রকৃতি ঋণ' নামে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করেন।
তমলুক, পাঁশকুড়া, হলদিয়া, কাঁথি, ময়না, ডেবরা, দাসপুরের পাশাপাশি হাওড়া জেলার বাগনান, দেউলটি ইত্যাদি জায়গায় গাছ লাগিয়েছেন শচীনন্দন। মূলত স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, হাট, বাজার, মন্দির, মসজিদ, সরকারি অফিস চত্বর, নদীর চর, রেলওয়ে স্টেশনে গাছ লাগান তিনি। ৫৫ বছরে পাঁচ লক্ষেরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন এই বৃক্ষপ্রেমী। ১৯৯৯ সালে 'ন্যাশনাল অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড ইকো ডেভেলপমেন্ট বোর্ড' থেকে এক প্রতিনিধি দল শচীনন্দনের কাজ দেখতে আসে। তাঁর কাজের সমস্ত তথ্য ও ছবি নিয়ে যান তাঁরা। সংগৃহীত তথ্য এবং ছবির ভিত্তিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তথ্য ও চিত্র সংবলিত একটি ইংরেজি স্মরণিকা প্রকাশ করে। সেটির নাম 'ওয়ান ম্যান মিশন ইন অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড ইকো-ডেভেলপমেন্ট এ কেস অফ সাকসেস'। ওই স্মরণিকার দৌলতে শচীনন্দনের কাজের খবর গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
২০০২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ভারত সরকারের বন ও পরিবেশ দপ্তর থেকে শচীনন্দনকে 'ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমিত্র পুরস্কার ২০০০' দেওয়া হয়। কলকাতা দূরদর্শন পরিবেশ সচেতনতার উপরে তাঁর একাধিক সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছিল। আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে নিয়মিত ডাক পান। ৮১ বছর বয়সেও থেমে নেই শচীনন্দন। সব জায়গায় নিজে যেতে না-পারলেও সহযোগীদের দিয়ে জারি রয়েছে তাঁর সবুজের অভিযান। পরিবারের কেউ শচীনন্দনের বৃক্ষপ্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। সব সময়ে তিনি পাশে পেয়েছেন স্ত্রী, ছেলে ও বৌমাকে। একজন মানুষ তাঁর সারা জীবনে ন্যূনতম ১৫টি গাছ যাতে লাগান তার জন্য আইন করার আবেদন জানিয়ে একাধিক বার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন শচীনন্দন।
তাঁর বৃক্ষপ্রেম ও জীবনী নিয়ে 'গাছের ঠাকুর' নামে একটি বইও লিখেছেন বীতশোক পট্টনায়ক এবং অমরাবতী হোসেন। স্কুল, কলেজ-সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ডাক পান বনসৃজন নিয়ে আলোচনার জন্য। ডাক পেয়েছেন পড়শি দেশ বাংলাদেশ থেকেও। ওপার বাংলায় গিয়েও শুনিয়ে এসেছেন প্রকৃতির ঋণশোধের কথা। শচীনন্দন বলেন, 'আমরা পিতৃ-মাতৃ খঋণ, গুরুর ঋণ নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু প্রকৃতির ঋণ নিয়ে আলোচনা কম হয়। প্রকৃতির ঋণ শোধ করার একটাই উপায়- ব্যাপক হারে গাছ লাগানো।' শচীনন্দনের স্ত্রী লক্ষ্মী সামন্ত বলেন, 'উনি নানা অনুষ্ঠানে ডাক পান। তবে ওঁর একটাই শর্ত- গাছ লাগাতে দিলে তবেই তিনি যাবেন।' শচীনন্দনের মতো মানুষের সংখ্যা বাড়লে পৃথিবীটা আরও একটু সবুজ হতে পারে।