এই সময়, আসানসোল: বায়ু দূষণে কলকাতাকেও হারিয়ে দিল আসানসোল–দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল!
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব। যা গত কয়েক বছরের সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। আসানসোলে গড়ে ৬ থেকে ১০ শতাংশ হারে বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়ছে। আসানসোল পুর এলাকার মধ্যে জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ, আসানসোল ও কল্যাণেশ্বরী–দেন্দুয়া এলাকায় দূষণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আসানসোলের দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ার সুদীপ ভট্টাচার্য বলছেন, ‘গত বছর দূষণ রোধ করতে না–পারায় আমরা ১২টি কারখানাকে জরিমানা করেছিলাম। জামুড়িয়ার একটি লোহার কারখানা কিছু দিন বন্ধও ছিল।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, এ বছরেও বর্ষার আগেই আসানসোল মহকুমার সমস্ত কারখানাকে আলাদা করে চিঠি পাঠিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কারখানার যে জমি রয়েছে, তার ৩৩ শতাংশে গাছ রোপণ করতে হবে। এই কারখানাগুলিতে এ মুহূর্তে কতটা সবুজায়ন হয়েছে তা বন দপ্তরের কাছেও জানতে চাওয়া হয়েছে। জেলাশাসক এস পোন্নাবলম বলছেন, ‘সম্প্রতি সরকারি ও বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিনিধিদের দূষণ নিরোধক যন্ত্রের ব্যবহার–সহ নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছ লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
ঠিক এই মুহূর্তে আসানসোলের বায়ু দূষণের মাত্রা ঠিক কেমন? দেখা গিয়েছে, ২০২০ সালে এখানে একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) ছিল ১০৬, ২০২১ সালে ১২১, ২০২২ সালে ১২৬, ২০২৩ সালে ১২০, ২০২৪ সালে ১৩৩। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত সেটা দাঁড়িয়েছে ১৫৭–তে। সোমবার আসানসোলের বায়ুতে একিউআই ছিল ১২১, যা অত্যন্ত খারাপ।
জামুড়িয়ায় শিল্পতালুকে ১১টি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা সমেত ১৪টি কারখানা রয়েছে। মঙ্গলপুরে রয়েছে সাতটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা। এ সমস্ত জায়গায় দূষণের হার ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় মানুষেরা বিক্ষোভ দেখান। প্রায় সমস্ত গাছের পাতাগুলির রং পর্যন্ত ধূসর হয়ে থাকছে। গত মাসেই আসানসোলের কালিপাহাড়িতে গত ৪০ বছর ধরে পুরসভা যে আবর্জনা জমা করেছে, সেখানে আগুন লেগে গিয়েছিল। ফলে দূষণের মাত্রা আরও বেড়েছে।
পুরসভা সূত্রের খবর, এই এলাকায় প্রত্যেক দিন ৪০০ টন আবর্জনা জমা হয়। কিন্তু সেই আবর্জনার নিয়মিত রিসাইক্লিংয়ের কোনও ব্যবস্থাই নেই। যে হেতু আসানসোল শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা কোলিয়ারি কেন্দ্রিক, ফলে সেখানে কাঁচা কয়লা পোড়ানোয় দূষণের মাত্রা তীব্র হয়েছে। এক দিকে, অধিকাংশ বাজার অঞ্চলে অবাধে কয়লা পুড়িয়ে দেদার চলছে ছোট দোকান থেকে হোটেল, অন্য দিকে, বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই দিয়ে একাধিক জায়গা ভরাট করা হচ্ছে। এই ছাই বাতাসে মিশছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্মাণ শিল্প। মার্বেল পাথর বা টাইলসের যে কাজ হয়, সেখানেও পাথরের গুঁড়ো মিশছে বাতাসে।
আসানসোল জেলা হাসপাতালের সুপার নিখিল দাস এবং প্রবীণ চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘এই ভয়ঙ্কর দূষণের কারণে শিল্পাঞ্চলে শ্বাসকষ্ট ,সর্দি–কাশি, ফুসফুসের অসুখ এবং চর্মরোগের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।’ চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্তের বক্তব্য, ‘বাতাসে ধুলিকণার সঙ্গে বিপুল পরিমাণে থাকছে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড। এতে শ্বাসকষ্ট বাড়ছে, ক্ষতি হচ্ছে হৃদপিণ্ড এবং চোখের। এ ছাড়াও নানা ধরনের রোগের উপসর্গ তৈরি হচ্ছে।’ পুরসভার মেয়র বিধান উপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘আমরা দূষণ নিয়ন্ত্রণে আগের থেকে অনেকটাই ভালো করার চেষ্টা করেছি এবং করছি।’
দু’বছর আগে আসানসোলের দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচুর টাকা খরচ করে তিনটি ড্রোন আনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এই ড্রোনগুলি দিয়ে বিভিন্ন থানা এলাকায় বায়ুর দূষণের মাত্রা নির্ণয় করা হবে। এই তিনটি ড্রোন ব্যবহৃত হবে ২৪ ঘণ্টা। কিন্তু এখন তা আর হচ্ছে না। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আধিকারিকদের বক্তব্য, কিছু সমস্যার কারণে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। ফের ড্রোন চালু করা হবে।
২০২০ সালে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে বাতাসে দূষণ কমাতে বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল পশ্চিম বর্ধমান জেলা প্রশাসনকে। বিশেষ করে, খনি ও শিল্পে দূষণরোধক যন্ত্রের ব্যবহারের সঙ্গে নির্দিষ্ট অংশে বৃক্ষরোপণ। খোলা আকাশের নীচে যে কোনও রকমের দহন রোধ করা, রাস্তার ভেঙে যাওয়া অংশের সংস্কার, গাড়ির ধোঁয়া থেকে দূষণের মাত্রা কমানো ইত্যাদি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ প্রায় ৩৪ কোটি টাকা দিয়েছিল আসানসোল পুর কর্তৃপক্ষকে। প্রস্তাবগুলি কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু করায় প্রথম দু’বছর বায়ূ দূষণের মাত্রা বেশ কিছুটা কমেছিল। কিন্তু শেষ তিন বছরে আবার দূষণের মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে।
সবমিলিয়ে আসানসোল শিল্পাঞ্চল ঢাকা পড়ছে বিষ–বাষ্পে।