• শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজ়মে
    এই সময় | ২৯ এপ্রিল ২০২৫
  • সব্যসাচী ঘোষ, মালবাজার

    আশির দশকে ডুয়ার্সের নির্জনতা, দার্জিলিংয়ের চা–বাগানের সাহেবি বাংলোর আভিজাত্যে শৈশব কেটেছিল। চোখের সামনে চেনা উত্তরকে একটু একটু করে বদলে যেতে দেখেছেন। শুরুটা হয়েছিল শহরের আর দশজন শিক্ষিত মেয়ের মতোই। শিলিগুড়ির একটি বিখ্যাত কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকার জীবন।

    সেখানে আরাম আছে, অর্থ আছে, কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার কই? নাম না জানা পাহাড়চুড়োর হাতছানি অমিল। খানিকটা সে কারণেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন ৩৮ বছরের তন্নিষ্ঠা রক্ষিত। স্বাবলম্বী হতে গিয়ে বিকল্প পেশা হিসেবে বেছে নিলেন পর্যটনকে। শিলিগুড়ির মেয়ের সেই প্রথম বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়া। নিজের রিসর্ট গড়ে তুললেন জঙ্গল লাগোয়া লাটাগুড়িতে।

    ‘ক্যাম্পিং ডে ডুয়ার্স’ নামের এই রিসর্ট গড়ে ওঠে ২০১৮ সালে। তিনটি কটেজ–সহ ছ’টি শয্যাঘর। সেই সঙ্গে একটা লাইব্রেরির আদলে বৈঠকখানা আর প্রায় দু’বিঘার সাজানো বাগান। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নান্দনিকতার ছোঁয়া আখেরে তন্নিষ্ঠার শিল্পবোধকেই তুলে ধরে। তবে, নিজের রিসর্ট গড়েই থেমে যাননি তন্নিষ্ঠা। মূলত লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাওয়া ছোট ছোট জনপদের বিষয়ে মনোযোগী হন তিনি, যেখানে পর্যটনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই এলাকার মানুষদের পর্যটনমনস্ক হিসেবে গড়ে তুলতে ও তাঁদের আর্থ–সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত হয় ‘অ্যাক্ট’ সংগঠন। পুরো নাম অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজ়ারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজ়ম। উত্তরের বিশিষ্ট পর্যটন ব্যক্তিত্ব রাজ বসুর উদ্যোগে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু। তন্নিষ্ঠা এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

    উত্তরের প্রায় প্রতিটি এলাকা চষে ফেলতে থাকেন। আলিপুরদুয়ারের টোটোপাড়া থেকে কালিম্পংয়ের প্রত্যন্ত পাহাড়ি রোমতি নদীর গিরিখাত ইয়েলবং গ্রামের মানুষদের নিয়ে শুরু হয় এক নতুন লড়াই। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজ়ম–কে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে জুড়তে উৎসবের আয়োজন করা হয়। ছেলেমেয়েদের ফুটবল দল করে শুরু হয় টুর্নামেন্ট। তিস্তাপাড়ে বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানীর ইতিহাসনির্ভর সন্ন্যাসী বিদ্রোহের যে পটভূমিকা, তাকে স্মরণে রেখে আনন্দমঠ স্মৃতিবন গড়ে তোলার কাজে এগিয়ে যান তন্নিষ্ঠা। বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় বর্তমানে সে কাজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। এই ‘অ্যাক্ট’ সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ পদে থাকার পাশাপাশি ক্রস বর্ডার ট্যুরিজ়মকে প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করছেন তিনি।

    তন্নিষ্ঠা বলেন, ‘অ্যাক্টের মাধ্যমে আমি পাহাড়, ডুয়ার্সের সঙ্গে নতুন ভাবে পরিচিত হয়েছি। যাঁরা খাদানের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, কিংবা জঙ্গলের গাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁরাই এখন আমাদের হাত ধরে পর্যটনের উন্নয়নে যোগ দিয়েছেন। এলাকার ইতিহাস ও ভূগোলকে রপ্ত করে পরিবেশকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন আমাদের লক্ষ্য। ধীরে হলেও তাতে সাফল্যও আসছে।’

    এখন ভারত–ভুটান পর্যটন বন্ধুতা প্রকল্পের প্রধান দায়িত্বে রয়েছেন তন্নিষ্ঠা। ভুটানের অনেক হোটেল–রিসর্টকে সঙ্গে নিয়ে দু’দেশের মধ্যে পর্যটন ও সংস্কৃতির আদানপ্রদানের কাজ শুরু হয়েছে। শিক্ষকতার নিশ্চিত পেশা ছেড়ে পর্যটনের দুনিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে পরিবারের উৎসাহ ছিল প্রথম থেকেই। স্বামী ও দুই সন্তানও ভ্রমণপিপাসু। তাঁরা সুযোগ পেলেই শিলিগুড়ির নাগরিক জীবন থেকে বেরিয়ে তন্নিষ্ঠার সঙ্গী হন।

  • Link to this news (এই সময়)