সাড়ে চারশো বছরের সম্প্রীতির লালনক্ষেত্র কান্দরা , মুসলিম ঘরে অধিষ্ঠিত জগন্নাথ রূপে ধর্মরাজ পুরোহিত শাহ আলম, নামাজও পড়েন নিয়মিত
বর্তমান | ৩০ এপ্রিল ২০২৫
অনিমেষ মণ্ডল, কাটোয়া: বাংলায় বিভেদের ঠাঁই নেই—প্রমাণ অনেক। কোথাও মুসলিমদের দান করা জমিতে মন্দির হয়েছে। কিংবা মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা হয়েছে। কোথাও দুর্গাপুজোর পরিচালনার দায়িত্ব সামলান মুসলিমরা। প্রাচীন মায়াপুরের চাঁদ কাজির সমাধির তত্ত্বাবধানে রয়েছেন বৈষ্ণবরা। সুন্দরবনে বনবিবির পুজো করেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। এমন সম্প্রীতির বাংলায় আরও এক অন্যতম উদাহরণ কেতুগ্রামের শাহ আলম। তাঁর বাড়িতে প্রভু জগন্নাথ রূপে পুজো পান বুড়ো ঠাকুর। আবার নামাজও পড়া হয় নিয়মিত, রোজা পালন করেন পরিবারের সকলেই। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে চলে আসা সম্প্রীতির এই ঐতিহ্যে আজও কোনও ফাটল ধরতে দেননি আলম সাহেব। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর রাজ্যব্যাপী বিদ্বেষ-আবহে এক অন্যমাত্রা যোগ করেছে এই মুসলিম পরিবারের ধর্মীয় উদারতা। আলম সাহেব যাকে বলতে চান, ‘মানবধর্ম। আমার পরিবার মানবতার পুজারি। মানবধর্মই হল সব ধর্মের সার কথা।’ তাঁর এই বার্তা এমন এক সময়ে যখন দীঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনকে ঘিরেও ভেদাভেদের রাজনীতি খুঁজতে মরিয়া একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল।
কেতুগ্রাম-১ ব্লকের কান্দরা মোল্লা পাড়ার শেষেই ভাণ্ডারি পাড়া। সেখানেই বাস করেন শাহ আলম। ওরফে টিটু খাদিম। স্ত্রী টুম্পা খাদিম ও দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওই বাড়িতেই প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে জগন্নাথ রুপে বুড়ো ধর্মরাজ ঠাকুর পুজিত হন। মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বীরভূম, হুগলি জেলা থেকে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ আসেন। ধর্মরাজের পুজো দেন। আর্শীবাদ নেন। টিনের চালের এক চিলতে মাটির বাড়ি। এক পাশে শাহ আলমের বাবা জাহেদ আলি খাদিমের সমাধি। লাগোয়া ঘরেই নিত্য পুজিত হচ্ছেন বুড়ো ধর্মরাজ। পুরোহিত শাহ আলম নিজেই। বংশপরম্পরা শেখানো মন্ত্রেই পুজো করেন তিনি। আবার পবিত্র ইসলাম ধর্মের আচার মেনে নামাজও পড়েন আলম সাহেব, রাখেন রোজাও।
মঙ্গলবার বুড়ো ধর্মরাজের পুজোর আসনে বসে আলম সাহেব বলছিলেন, ‘আমার বাড়িতে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ আসেন। তাঁদের মানবতার পাঠ দিই। বলি, আগে আমরা মানুষ। তারপর আমাদের ধর্ম। আমার পরিবারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঠ হয়। পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখা হয়। নিত্য জগন্নাথ রূপে বাবা বুড়ো ঠাকুরেরও পুজো হয়। বাড়িতে রয়েছে শিবের ত্রিশূল।’ কীভাবে এই সহাবস্থান? শাহ আলম জানিয়েছেন, তাঁদের পূর্বপুরুষ স্বপ্নাদেশ পেয়ে বাড়িতে বুড়ো ঠাকুরের পুজো শুরু করেছিলেন। বুড়ো ঠাকুর বলতে বাবা ধর্মরাজ। কিন্তু ধর্মরাজের ঘোড়া বিগ্রহ, যা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তাঁর কোনও পা নেই। তাই তিনি প্রভু জগন্নাথ। তাঁরই রূপে বুড়ো ঠাকুর পুজো পান। একসময় দারুমূর্তিটি জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এরপরেই নাকি পরিবারে অমঙ্গল নেমে আসে। ফের বাড়ির এক সদস্য স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেই মূর্তি তুলে এনে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই পুজিত হয়ে আসছেন বাবা ধর্মরাজ। শাহ আলমের স্ত্রী টুম্পা খাদিম বলছিলেন, ‘বাড়িতে হিন্দু ভক্তদের আনাগোনা লেগেই থাকে। আমি নামাজ পড়ি। রোজাও রাখি। স্বামী বাড়িতে না থাকলে ধূপ-ধুনো দিয়ে বাতাসা দিই বুড়ো ধর্মরাজকে।’ শাহ আলমের সংযোজন—‘মুখ্যমন্ত্রী দীঘাতে জগন্নাথ দেবের মন্দির উদ্বোধন করছেন। আমি আনন্দিত। পারলে একবার গিয়ে দেখেও আসব। ধর্ম নিয়ে যারা বিভেদের রাজনীতি খোঁজে, আমি তাঁদের মানুষ বলে ভাবি না।’ আলম সাহেবের ছোট্ট বাড়িতে ঢুকলেই চোখে পড়বে লাল জবা ফুলের গাছ। পাশেই বেলগাছ। রয়েছে তুলসি তলা। গ্রামের মসজিদে সন্ধ্যায় আজান শুরু হলে তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বালান শাহ আলমরা। বাংলায় সম্প্রীতির এক সেরা বিজ্ঞাপন। যার ক্যাচলাইন—ধর্ম নয়, মানুষের পরিচয় মনুষ্যত্বে। -নিজস্ব চিত্র