অয়ন ঘোষাল, তথাগত চক্রবর্তী ও রণয় তিওয়ারি: ফিরল স্টিফেন কোটে স্মৃতি! রাতের কলকাতায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হল ১৪ জনের। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে রান্নাঘর থেকেই আগুন লেগেছে। মৃতদেহ রাখা হয়েছে কলকাতা মেডিক্য়াল, এনআরএস মেডিক্যাল ও আরজি কর মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১১, মহিলা ১, শিশু কন্যা ১ ও শিশু পুত্র ১ জন। মৃতদের অনেকেই ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। একজন হোটেল থেকে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান।
মঙ্গলবার রাত ৮টা নাগাদ আগুন লেগে যায় বড়বাজারের মেছুয়ার মদন মোহন বর্মন স্ট্রিটে 'ঋতুরাজ' হোটেলে ৬ তলায়। চোখের নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে আগুনে লেলিহান শিখা। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারপাশ। আগুনের গ্রাসে চলে যায় গোটা হোটেলটিই। আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকেন হোটেলের আবাসিকরা। কেউ কেউ কার্নিসে ঝুলতে থাকেন। জানা যাচ্ছে বেরিয়ে আসার আপাতকালীন রাস্তা ছিল হোটেলে। খবর পেয়েই ছুটে আসে দমকল। দ্রুত বাড়তে থাকে দমকলের ইঞ্জিনের সংখ্যা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিপিন গনোত্রা জানিয়েছেন, আগুনে ঝলসে কারও মৃত্যু হয়নি। একজন ঝাঁপ দিয়ে নীচে পড়ে যান। বাকীদের বেশিরভাগই সিঁডির কাছে পড়েছিল। কারণ ধোঁয়া থেকে বাঁচতে তারা সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসের চেষ্টা করেন। সেখানেই ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তাদের। এখনও পর্যন্ত যা খবর তাতে মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে যাওয়ার পর ৪ জনকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়, আর জি করে ৫ জন ও এনআরএস-এ ৫ জনকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
বুধবার সকালে দেখা গেল পুলিস গোটা এলাকায় ঘিরে দিয়েছে। হোটেলের সামনে থেকে রবীন্দ্র সরণি পর্য়ন্ত রাস্তা কর্ডন করে ঘিরে দেওয়া হয়। কারণ পুলিস চাইছে না কোনও প্রমাণ লোপাট হোক। প্রত্যক্ষদর্শী বিপিন গনোত্রা বলেন, থার্ড ফ্লোরে দমকলের সঙ্গে জল দিচ্ছিলাম। তাপ ও ধোঁয়ার জন্য এগোতে পারছিলাম না। সিঁড়িতে,বারান্দায়, ঘরের মধ্যে মৃতদেহ পড়েছিল। দোতলা ও তিনতলায় প্রবল আগুন লেগে যায়। অধিকাংশেই মৃত্য়ু হয়েছে ধোঁয়ার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। তবে ময়না তদন্তের আগে মৃত্য়ুর কারণ সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। ঘটনার তদন্তে সিট গঠন করা হয়েছে।
আগুনের খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, কীভাবে এমন আগুন লাগল তা দমকল ও পুলিস খতিয়ে দেখবে। এফআইআর হবে। আইনত ব্যবস্থা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। অনেককে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। বম্বের একজনকে এভাবে উদ্ধার করা হয়েছে।উপর থেকে ১৫ জনকে বের করা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পাশাপাশি মৃতদের পরিবারের জন্য ২ লক্ষ টাকা ও আহতদের ৫০ হাজার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন তিনি।
এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত মৃতের তালিকা
মেডিক্যাল কলেজ ৪
১) এস মুত্থু কৃষ্ণন (৬১)
২) ৩ জন অজ্ঞাত ( ৪৫/৫১/৫৫)
এন আর এস
১) দীপ্তেন্দ্র রাম (৪৬)
২) পি রাউত (৩ বছর ৮ মাস)
৩) পি দিয়া (৮ বছর)
৪) প্রণয় পাঠক (১৩)
৫) আরাধ্যা আগরওয়াল (২২)
আর জি কর
১) রাজেশ সন্তকার (৬১)
২) নীরজ কুমার (২০)
পুরুষ অজ্ঞাত ৫৬
পুরুষ অজ্ঞাত ৩৪
পুরুষ অজ্ঞাত
গত ৬ মাসে, শহরে বড় অগ্নিকাণ্ড
(১) ২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বর = যাদবপুর থানা এলাকার লর্ডস বেকারি মোড়ে, সন্ধ্যা বাজারে আগুন।
একের পর এক দোকান ও গ্যারেজ পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।
(২) ২০২৪ সালের ১৫ নভেম্বর = নিমতলা ঘাটের কাছে মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডে, গভীর রাতে কাঠের গোডাউনে বিদ্ধঅংশী আগুন লাগে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৭ টিরো বেশি পরিবার। ঘটনাস্থলে যায় দমকলের ২০ টিরো বেশি ইঞ্জিন।
(৩) ২০২৪ সালের ২২ নভেম্বর = গড়িয়াহাট থানা এলাকার কাকুলিয়া রোডের বস্তিতে বিদ্ধঅংশী আগুন।
৭টি টালির ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে আসে দমকলের ৭টি ইঞ্জিন।
(৪) ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর = তিলজলা থানা এলাকার তপসিয়ার মজদুর পাড়ার বস্তিতে আগুন।
আগুনে পুড়ে যায় শতাধিক ঝুপড়ি। ঘটনাস্থলে আসে দমকলের ১৮টি ইঞ্জিন।
(৫) ২০২৪ সালের ২১ ডিসেম্বর = বিপি পোদ্দার হাসপাতালের কাছে দুর্গাপুর ব্রিজের নিচে নিউ আলিপুর বস্তিতে আগুন। শতাধিক ঝুপড়ি পুড়ে যায়। ঘটনাস্থলে আসে দমকলের ১৬টি ইঞ্জিন।
(৬) ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি = বেনিয়াপুকুর থানা এলাকার তিলজলা রোডে, পার্ক সার্কাস স্টেশনের কাছে রাবার ফ্যাক্টরি তে আগুন।
ঘটনাস্থলে আসে দমকলের ১০টি ইঞ্জিন। পুড়ে ছারখার হয়ে যায় কারখানাটি।
(৭) ২০২৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি = নারকেলডাঙা থানা এলাকার ক্যানেল ওয়েস্ট রোডের বস্তিতে আগুন।
ঘটনায় হাবিবুল্লা মোল্লা নামে ৬২বছর বয়সী এক ব্যাক্তির মৃত্যু। নাজাট থানা এলাকার পাথরঘাটা রাজবাড়ি এলাকার বাসিন্দা।
একাধিক ঝুপড়ি পুড়ে যায়। ১৬টি ইঞ্জিনের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
(৮) ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি = তারাতলা থানা এলাকার সিপিটি কলোনির বস্তিতে আগুন লাগে। ২০ থেকে ২৫টি ঝুপড়ি ঘর পুড়ে ভস্যিভূত হয়ে যায়।
ঘটনাস্থলে আসে দমকলের ৫টি ইঞ্জিন, এছাড়া পোর্ট ট্রাস্টের আসে দুটি ইঞ্জিন। ঘন্টা দুয়েকের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
(৯) ২০২৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি = এন্টালি থানা এলাকার শিয়ালদা ব্রিজের তলায় আগুন লাগে।
২০টিরো বেশি দোকান পুড়ে যায়। ঘটনাস্থলে আসে দমকলের ৮টি ইঞ্জিন। ঘন্টা দুয়েকের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
(৯) ২০২৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি = প্রগতি ময়দান থানা এলাকার ধাপার কাছে আরুপোতায় একটি গ্যারেজে আগুন লাগে। প্রায় ৮টি গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে আসে দমকলের ৪টি ইঞ্জিন। প্রায় পৌনে দুঘন্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
(১০) ২০২৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি = রবীন্দ্র সরোবর থানা এলাকার শরৎ বোস রোডে গভীর রাতে একটি ডেকোরেটার্স এর গোডাউনে আগুন লাগে।
ঘটনাস্থলে আসে দমকলের ১০টি ইঞ্জিন। ৫ঘন্টা ৩৫মিনিট পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
(১১) ২০২৫ সালের ২০ এপ্রিল = জোড়াবাগান থানা এলাকার পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে একটি কাপড়ের গুদামে আগুন লেগে গিয়ে, কিষান লাল উপাধ্যায় (৫৮) ও সুনীল কুমার শর্মা (৪৮) নামে দুজনের মৃত্যু হয়। এছাড়া আহত হন আরও দুজন।
১৫টি ইঞ্জিনের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
(১২) ২০২৫ সালের ২৬ এপ্রিল = প্রগতি ময়দান থানা এলাকার ধাপার দুর্গাপুরে আগুন লাগে।
একটি ট্রান্সফরমার ব্লাস্ট করে আগুন ধরে যায় একটি টায়ারের কারখানায়, সেখান থেকে আগুন ধরে যায় প্লাস্টিক গুদামে। কারখানায় থাকা মাল ভর্তি একটি ট্রেলার সম্পূন্য ভস্যিভূত হয়ে যায়।
এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।