• বড়বাজারে হোটেলে আগুন, মৃত্যু বেড়ে ১৪
    বর্তমান | ০১ মে ২০২৫
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: মঙ্গলবার ঘড়িতে রাত ৯টা ৫ মিনিট। জ্বলছে বড়বাজারে চিৎপুর মোড় সংলগ্ন ঋতুরাজ হোটেল। দমকল এসেছে উঁচু ল্যাডার নিয়ে। দরজা দিয়ে ঢোকার উপায় নেই। যদি আটকে থাকা মানুষগুলোকে মই বেয়ে নামিয়ে আনা যায়। হুড়োহুড়ি, উৎকণ্ঠা, আর আতঙ্ক... এই ছবিই তখন গ্রাস করে ফেলেছে গোটা বড়বাজার চত্বরকে। ঋতুরাজের সামনে ভিড়। কোনও বোর্ডারের বাবা, আর দুই সন্তান ভিতরে আটকে। ফোন করছেন তিনি। বারবার। উৎকণ্ঠায় নম্বর ডায়াল করে চলেছেন কোনও বাবাও। তাঁর ছেলে হোটেলকর্মী। কিন্তু আতঙ্ক বাড়ছে। কারণ ফোনগুলো নিরুত্তর। ল্যাডার বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠছেন দমকল ও কলকাতা পুলিসের বিপর্যয় মোকাবিলা দলের কর্মীরা। জানালা ভেঙে মানুষকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। নীচে চলছে অনবরত মাইকিং। আশ্বস্ত করা হচ্ছে সকলকে। আটকে থাকাদের নিকটজনের থেকে ফোন নম্বর, নাম নিচ্ছে পুলিস। দমকলের ১১টি ইঞ্জিনের চেষ্টায় ততক্ষণে অবশ্য আগুন প্রায় নিয়ন্ত্রণে। কার্নিশে দাঁড়িয়ে থাকা আতঙ্কিত মানুষজনকে নামিয়ে আনা হচ্ছে। স্বস্তি কিন্তু মিলল না। কারণ, হোটেলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক দেহ। নিথর। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে চাপিয়ে কাউকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এন আর এস, কাউকে আর জি কর, কাউকে মেডিক্যাল কলেজে। কেউ অগ্নিদগ্ধ, কিন্তু বেশিরভাগই দমবন্ধ হয়ে সাড়া দেওয়ার অবস্থায় নেই। রাত থেকে ভোর হল। সঙ্গে বাড়ল মৃত্যুমিছিল। পুলিস জানাল, প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ জন। আর অসমর্থিত সূত্রের খবর, নিখোঁজ এখনও তিনজন। মৃতরা সকলেই তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ কিংবা ওড়িশার বাসিন্দা। মর্মান্তিক এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উদ্বেগ প্রকাশ করে দীঘা থেকেই বারবার খোঁজ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্ধারকাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, সেইমতো নির্দেশও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী, দু’জনই মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন। 

    ৬ নম্বর মদনমোহন বর্মন স্ট্রিটের ছ’তলা বিল্ডিং। চেষ্টা করেছিলেন হোটেলের দুই কর্মী... ঝাঁপ দিয়ে যদি বাঁচা যায়। জানালার কাচ ভেঙে কার্নিশে নেমেছিলেন। তারপর ঝাঁপ। পারেননি মনোজ পাসোয়ান। তবে বেঁচে গিয়েছেন সঞ্জয় দাস। তিনি বর্তমানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন। দমকলের ল্যাডার আসার আগে অবশ্য স্থানীয়রাই এগিয়ে আসেন। কার্নিশে উঠে কাচ ভেঙে আটকে থাকা লোকজনকে বের করে আনার চেষ্টা করেন তাঁরা। দড়ি বেঁধে কাউকে কাউকে নামিয়েও আনেন স্থানীয়রা। পরে দমকলের ল্যাডার এলে গতি পায় উদ্ধারকাজ। তবে আগুন নেভার পরও তাপ এতটাই বেশি ছিল যে, সঙ্গে সঙ্গে দমকল কর্মীরা ভিতরে ঢুকতে পারেননি।

    ওই বিল্ডিংয়ের দোতলায় নতুন একটি বার তৈরির কাজ চলছিল। তাই জায়গাটা ঘিরে রাখা হয়েছিল দেওয়াল তুলে। প্রথমে দোতলার সেই ঘরের ইটের দেওয়াল ভাঙা হয়। গল গল বেরতে থাকে কালো ধোঁয়া। পাইপ ঢুকিয়ে জল দিয়ে তা আয়ত্তে আনেন উদ্ধারকারীরা। তারপর ল্যাডার দিয়ে ধীরে ধীরে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তল থেকে জানলা ভেঙে আটকে থাকাদের উদ্ধার করে পাশের বাড়ির ছাদে নামানো হয়। তাঁরা সকলেই তখন ট্রমার মধ্যে। ধোঁয়ায় প্রায় দমবন্ধ। ১৩ জনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ১২ জনকেই প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। রাত ১টার পর হোটেলের ঘর থেকে দুই শিশুকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আর তারপর রাত যত গড়িয়েছে, ততই বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যা। দমকলের এক কর্মী বলেন, ‘একের পর এক দেহ। কেউ সিঁড়িতে পড়ে। কেউ ঘরে।’ 

    রাতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান কলকাতার পুলিস কমিশনার মনোজ ভার্মা। রাত ৩টে পর্যন্ত ছিলেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমও। ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্তে সিট গঠন করেছে লালবাজার। আটক করা হয়েছে হোটেলের ম্যানেজারকে। বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থলে যায় ফরেন্সিক টিমও। রাত পর্যন্ত চলে তদন্ত। কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের কর্তারাও সেখানে যান। সকাল থেকেই হোটেলের অন্যান্য বাসিন্দারা অকুস্থলে আসেন। তাঁরা নিজেদের মালপত্র বের করে আনার জন্য অনুরোধ জানান পুলিসকে। কিন্তু অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। দমকলের ডিজি রণবীর কুমার জানান, আগুনের উৎস দোতলার ঘর। সেখানেই পানশালা ও রেস্তরাঁ তৈরি হচ্ছিল। রান্নাঘরে কোনওভাবে আগুন লাগে। গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটতেই আগুন একের পর এক তলে ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার পরিকাঠামো সঠিকভাবে ছিল না বলেও জানিয়েছে দমকল। পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘দুটি সিঁড়ি থাকলেও আগুনের ভয়াবহতায় সেগুলি ব্যবহারের অবস্থায় ছিল না। স্বাভাবিকভাবে আগুন লাগার পর লিফ্টও বন্ধ ছিল। ফলে, লোকজন নীচে নেমে আসতে পারেননি। স্থানীয়রা অবশ্য‌ দা঩বি করেছেন, মালপত্র রেখে সিঁড়ি আটকানো ছিল। বেরিয়ে আসার সুযোগ ছিল না।
  • Link to this news (বর্তমান)