• জতুগৃহ বড়বাজার, প্রাণ হাতে নিয়েই চলছে ব্যবসা, বসবাস
    বর্তমান | ০১ মে ২০২৫
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: চিৎপুর মোড় থেকে ডানদিকে ঢুকলেই ডানহাতেই রয়েছে একটি পেট্রল পাম্প। তার পাশের গলি দিয়ে ঢুকে গেলেই মদনমোহন বর্মন স্ট্রিট। সেই গলির ছয় নম্বর বাড়িটি একটি হোটেল। মঙ্গলবার রাতে সেই হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের জেরে ১৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, সেখানে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার সঠিক পরিকাঠামো ছিল না। ফলে আগুন লাগলে তা কাজ করেনি। কিন্তু সেই আশির দশক থেকে চলা এই ছ’তলা হোটেলই শুধু নয়, গোটা রাস্তাতেই এপার-ওপারে রয়েছে ধর্মশালা থেকে শুরু করে প্রাচীন একাধিক বিল্ডিং। কোনওটা দৃশ্যত বেআইনি নির্মাণ, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার বালাই নেই। সেখানেই ঘুপচি ঘরে চলছে বসবাস, ব্যবসা। বড়বাজার, পোস্তা জুড়ে সর্বত্র অলিগলিতে একই ছবি। সব মিলিয়ে কার্যত জতুগৃহ বড়বাজার! 

    বুধবার সকালে অকুস্থলে গিয়ে দেখা গেল, সারি সারি দমকলের ইঞ্জিন। অগ্নিদগ্ধ হোটেলের ঠিক উল্টোদিকের ফুটপাতে বড় বড় বস্তায় মালপত্র ডাঁই করে রাখা। উল্টোদিকের বিল্ডিংটির অবস্থা তথৈবচ! কোথাও পলেস্তরা খসে পড়েছে, কোথাও প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। চুলোয় যাক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা! নীচের দোকানে মালপত্রের মাঝেই এক কোণে বসে খাচ্ছিলেন পরেশ পাসোয়ান। গতকাল রাতের ঘটনা তিনি চোখের সামনে দেখেছেন। বললেন, ‘ওরা দু’জন তিনতলা থেকে ঝাঁপ মারল। অনেকেই বারণ করেছিল, কিন্তু শোনেনি। তাও এই হোটেলের অবস্থা অনেকটা ভালো। কিন্তু আমাদের দোকান যে বিল্ডিংয়ে রয়েছে, তার অবস্থা দেখুন! এখানেই থাকা, খাওয়া, ব্যবসা সবকিছু। ভয় তো লাগেই। কিন্তু যাব কোথায়?’ পাশেই ছিলেন নকুল সিনহা, সঞ্জয় হরিদাসরা। সকলের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। তাঁদের কথায়, ‘কাল আমরাও উদ্ধার কাজে নেমেছিলাম। গ্রিলের সঙ্গে দড়ি লাগিয়ে কাউকে কাউকে উদ্ধার করা গিয়েছে। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামতে পারেনি। অতজন দম বন্ধ হয়ে মার গেল!’ 

    চিৎপুর রোড, মদনমোহন বর্মন স্ট্রিট, কলাবাগান বস্তি, রাজস্থান স্ট্রিট, কলাকার স্ট্রিট থেকে শুরু করে মেছুয়া বাজার, পোস্তা, পাথুরিয়াঘাটা সহ জোড়াসাঁকোর বিস্তীর্ণ এলাকায় ছবিটা একই রকম। দখলদারির জেরে অপরিসর হয়ে গিয়েছে বড় রাস্তা। রাতের ফুটপাতে একের পর এক জায়গায় মালপত্র ডাঁই করে রাখা। গা ঘেঁষা পুরনো কলকাতার সাবেকি বাড়ি। তার উপর আবার বিল্ডিং নির্মাণের নিয়ম কিংবা দমকলের নিয়মের তোয়াক্কা না করে একের পর এক অবৈধ নির্মাণ। কোথাও আবাসিক ভবন পাল্টে গিয়েছে কমার্শিয়াল ব্যবহারে। সেসব জানেই না কলকাতা পুরসভা। ছোট ছোট পায়রার খোপের মতো ঘর বানিয়ে তৈরি হয়েছে দোকান, গুদাম। নেই কোনও অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা। ফলে আগুন লাগলে কী হবে? ‘কপালে থাকলে বাঁচব, নাহলে মরব, এটাই কাজের জায়গা। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’ বলে ওঠেন চিৎপুর মোড় সংলগ্ন কাপড়ের দোকানের কর্মচারী বিকাশ মিশ্র। 

    এর আগেও বড়বাজার অঞ্চলে কোনও না কোনও জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকদিন আগে পাথুরিয়াঘাটাতেও একটি বিল্ডিংয়ে আগুন লাগে। সিঁড়ি বন্ধ থাকার জেরে বাইরে বের হতে না পেরে দমবন্ধ হয়ে মারা যান দুই পুরোহিত। সেখানেও ধর্মশালাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে দোকান এবং গুদাম বানানোর বিষয়টি সামনে এসেছে। কয়েক মাস আগে পোদ্দার কোর্টের অদূরেও একটি বাজারে আগুন লাগে। সেখানে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বেগ পেতে হয় দমকলের গাড়িকে। কারণ রাস্তার বিভিন্ন জায়গা দখল হয়ে পড়েছিল। ফের শহরের বুকে মঙ্গলবারের এই ঘটনায় ১৪ জনের মৃত্যু মিছিল আতঙ্ক ধরিয়েছে বড়বাজারবাসীর মনে। কিন্তু, তাতে কি পরিস্থিতি বদলাবে এই অঞ্চলের? উত্তর অধরা।
  • Link to this news (বর্তমান)