মন্দির নিয়ে প্রশ্নের মুখে মুখ্যমন্ত্রী, আসছে রাম মন্দিরের তুলনাও
আনন্দবাজার | ০১ মে ২০২৫
লোকসভা ভোটের আগে অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের ঘনঘটায় ভোটের রাজনীতির অভিযোগ উঠেছিল নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে। এ বার জগন্নাথ মন্দির নিয়ে একই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিরোধীদের অভিযোগ তো বটেই, এই পর্বে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরেও যে ‘প্রত্যাশা’ তৈরি হয়েছে, তাতেও সেই অভিমুখ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
মন্দিরের উদ্বোধন এবং জগন্নাথের প্রাণ-প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে চার দিন মন্ত্রী, আমলা-সহ সপার্ষদ দিঘায় থাকছেন মুখ্যমন্ত্রী। পরপর দু’দিন মন্দির ও জগন্নাথ দেবের জন্য বরাদ্দ করা রয়েছে। সাধারণ ভাবে প্রশাসনিক কাজের চাপের মধ্যে দিঘায় মুখ্যমন্ত্রীর এ বারের অবস্থানের পিছনে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে বলেও মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। বিশেষ করে, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি মমতার সরকার ও রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে ধর্মকেন্দ্রিক তোষণের যে অভিযোগ তোলে, দিঘায় মুখ্যমন্ত্রীর মন্দির প্রতিষ্ঠাকে তা খণ্ডন করার চেষ্টা বলেও দেখছে তাদের একাংশ। তৃণমূল অবশ্য অযোধ্যা ও দিঘার মন্দির নিয়ে এই তুলনামূলক আলোচনাকে বিজেপির ‘হতাশার বহিঃপ্রকাশ’ বলে দাবি করছে।
দিঘার মন্দিরে মঙ্গলবার ‘মহাযজ্ঞ’ পর্বে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। থাকবেন বুধবার প্রাণ-প্রতিষ্ঠা কালেও। আর তাতেই অযোধ্যায় রামচন্দ্রের প্রাণপ্রতিষ্ঠার সময়ের রাজনৈতিক সমালোচনা ফিরেছে রাজ্য রাজনীতিতে। কংগ্রেস, সিপিএমের মতো দলগুলির পাশাপাশি তৃণমূলও দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে সেই সময়ে প্রশ্ন তুলেছিল। সরকারি অর্থে মন্দির তৈরিতে সাংবিধানিক বাধা নিয়ে গোড়া থেকেই অবশ্য সতর্ক ছিল নবান্ন। মন্দির তৈরি হলেও গোটা পরিকল্পনাটি নগরোন্নয়ন দফতরের তত্ত্বাবধানে একটি সাংস্কৃতিক অছি পরিষদের নামে করা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত ধর্মীয় আচারে মুখ্যমন্ত্রী-সহ মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য ও শাসক দলের উপস্থিতির জেরে সেই মোড়কও কার্যত কাগুজেই রয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গত কয়েক দিন ধরে দিঘার মন্দিরের ছবি-সহ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পূর্ণ বিবরণের প্রচার শুরু করেছেন তৃণমূলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে দল ও প্রশাসনের তরফে গোটা রাজ্যে জগন্নাথের প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যত্র তো বটেই, রাজ্য বিধানসভাতেও সেই আয়োজন করছে পূর্ত দফতর।
রামমন্দিরে মোদী ও জগন্নাথ মন্দিরে মমতার ভূমিকাকে এক বন্ধনীতেই রাখছে রাজ্যের সিপিএম ও কংগ্রেস। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মতে, ‘‘রাজ্যে যখন ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল, দুর্নীতিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিপন্ন, সেই সময়ে সরকারের ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ সেজে থাকাই সুবিধাজনক। আর দেখাই যাচ্ছে, অযোধ্যায় রাম মন্দিরে প্রচার-ছবি সবেতেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এখানে জগন্নাথ মন্দিরে রাজকীয় ঢক্কানিনাদ সবটাই মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে। ওখানে উদ্বোধনে উনি। এখানে যজ্ঞের পরে পূর্ণাহুতি, সবই ইনি। রাজনীতির ধান্দা এবং ব্যবসায় মোদী-দিদি একেবারে পরিপূরক।’’ একই সুরে ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার অভিযোগ করেছে কংগ্রেসও। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারের বক্তব্য, ‘‘ভক্তেরা মন্দির করতেই পারেন। তবে জগন্নাথ দেবের কাছে কামনা করি, যাঁদের তিনি ক্ষমতা দিয়েছেন, তাঁদের একটু সুমতিও দিন। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, সরকারি দফতরে ভাল ভাবে আরও শৌচালয় তৈরি হোক, মানুষের স্বাস্থ্যের উপকার হোক। শিব্রাম চক্রবর্তী তো বলেছিলেন, শৌচালয়ের উপকারিতা সর্বজনীন।’’
দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন প্রসঙ্গে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, “সরকারের টাকায় কখনও মন্দির তৈরি হয় না— যার সরকারি নাম জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।” রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যেরও দাবি, ‘‘বিজেপি মন্দির নিয়ে রাজনীতি করে না। রাম মন্দির ছিল বিদেশি আক্রমণের ক্ষত মোছার লড়াই। মুখ্যমন্ত্রী যখন বুঝেছেন কালীঘাট মন্দিরে ফাইল নিয়ে গিয়ে আর সুবিধা হচ্ছে না তাই জগন্নাথ দেবের শরণাপন্ন হচ্ছেন!’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘ওঁর যদি এত ভক্তি থাকে, উনি তৃণমূলের টাকা দিয়ে মন্দির করতে পারতেন। জনগণের থেকে টাকা তুলতে পারতেন। করের টাকায় কেন মন্দির করছেন?’’
বিরোধীদের প্রশ্ন উড়িয়ে তৃণমূলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার অবশ্য বলেছেন, ‘‘রাম মন্দিরে কার্যত পুরোহিতের ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ভোটের মাসদুয়েক আগে তা নিয়ে রাজনৈতিক প্রচার তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। তার সঙ্গে দিঘার সম্প্রীতি কেন্দ্রের কোনও তুলনাই হয় না।’’ বিজেপিকে খোঁচা দিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘এখন যে বিরোধী দলনেতা আপত্তি করছেন, মন্ত্রী হিসেবে তিনি ও তাঁর বাবা, সাংসদ শিশির অধিকারী মন্দিরের জায়গা দেখতে গিয়েছিলেন। সে দিন তাঁদের আপত্তি ছিল না!’’ মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে ‘ঐতিহাসিক’ চিহ্নিত করে তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় এক্স হ্যান্ড্লে লিখেছেন, ‘জগন্নাথের ভক্তদের জন্য দিদি এক নতুন দৃশ্য তৈরি করলেন’!