• মেছুয়ার অগ্নিকাণ্ড: ষোলোর লোকেশ শেখাল বাঁচার কায়দা
    এই সময় | ০১ মে ২০২৫
  • আকাশ আগরওয়াল (বারগড়, ওডিশা)

    বাড়ির কচিকাঁচাদের সবার পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে। ওরা বায়না ধরেছিল কলকাতায় বেড়াতে যাবে। আমি মাঝেমধ্যেই ব্যবসার কাজে কলকাতায় আসি। তবে এ বার ওরা বায়না করেছিল, শুধু কলকাতা ঘোরা নয়, ইডেন গার্ডেন্সে আইপিএলের ম্যাচও দেখবে। আমারও কিছু কাজ ছিল, তাই নিয়ে চলে এলাম। আমার দুই ছেলে, স্ত্রী আর দুই ভাইপোকে নিয়ে গত ২৬ এপ্রিল কলকাতা এসেছি।

    কথা ছিল, মঙ্গলবার রাতের ট্রেন ধরে ওডিশা ফিরে যাব। সেই মতো আমরা চেক আউটের ফর্মালিটি সারছিলাম। কিছু লাগেজ নিয়ে আমার দুই ছেলে আর এক ভাইপো ততক্ষণে নীচে নেমে এসেছে। বাকিরা হোটেলের ফোর্থ ফ্লোরের রুমে শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ সেরে বেরনোর তোড়জোড় করছিলাম। রুমে আমার সঙ্গে ছিলেন আমার স্ত্রী নেহা আর সদ্য ক্লাস টেনের বোর্ড পরীক্ষা দেওয়া ভাইপো লোকেশ। এই লোকেশের জন্যই মঙ্গলবার আমরা কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচেছি বলতে পারেন।

    রাত তখন সাড়ে সাতটা আটটা হবে। আমাদের সবার হঠাৎ চোখ জ্বালা করতে শুরু করেছে। সঙ্গে বিকট পোড়া গন্ধ। আমরা প্রথমে পুরো ব্যাপারটায় গা করিনি। নীচ থেকে আমার বড় ভাইপো ময়াঙ্ক ফোন করে বলল, হোটেলে নাকি আগুন লেগেছে! আমি ওকে বললাম, তুমি মালপত্রের চিন্তা ছাড়ো। বাকিদের নিয়ে হোটেল থেকে যতদূর সম্ভব দূরে সরে যাও। সে তো আমাদের ফেলে কিছুই যাবে না।

    দ্রুত আমাদের পুরো রুমটা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। খানিক দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ক্রমশ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি এমনিতে ঠান্ডা মাথার ছেলে, আমার স্ত্রীও তাই। কিন্তু এত ধোঁয়া দেখে প্রাণভয়ে আমরা কিছুটা প্যানিক করে ফেলেছিলাম। বিশেষ করে আমার স্ত্রী। এই অবস্থা আরও কিছুক্ষণ চললে আমরা হয়তো ভয়ে বা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতাম। কিন্তু সেটা হয়নি আমাদের ১৬ বছর বয়সি ভাইপো লোকেশের জন্য।

    স্কুলে ও নানা রকম সাবজেক্ট পড়েছে। পরে শুনলাম, ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্টও নাকি ওদের সিলেবাসে রয়েছে। সেই শিক্ষাই কাল কাজে এল। লোকেশই আমাদের বার বার বলছিল, প্যানিক না–করতে। ও আমাদের বলল, বোতলের জল থেকে রুমাল বা গামছা হাতের কাছে যা কিছু কাপড় আছে, কয়েকটা ভিজিয়ে নাক–মুখটা বেঁধে নিতে। ও নিজেও তা–ই করল। তাতে খানিকটা সম্বিত ফিরল। কিন্তু রুম থেকে বেরনোর তো পথ নেই। কারণ, আগুনের উৎসটা তো নীচেই (পরে জেনেছি দোতলায়)। তা হলে বেরোবো কী ভাবে?

    লোকেশ আমাদের বলল, আগে রুমের জানলাটা ভাঙার প্রাণপণ চেষ্টা করতে। আমাদের ঘরে তিনটে জানলা ছিল। দুটোর কাচ ভাঙার পরে দেখলাম নীচে নামার কোনও উপায় নেই। কারণ গ্রিলের খাঁচায় জানলার মুখটা আটকানো। তারপরে তিন নম্বর জানলাটাও ভাঙলাম। ভগবানের অশেষ কৃপা যে, সেখানে জানলার মধ্যে একটা ছোট্ট পাল্লা ছিল, যেটা খোলা যায়। লোকেশ আমাদের বলল, যত কষ্টই হোক প্রাণে বাঁচার একটাই উপায়। এই জানলা দিয়েই নীচে নামতে হবে।

    নীচে নেমে দেখলাম, একটা কার্নিশ মতো রয়েছে। কোনও রকমে একে একে আমরা তিনজন সেই কার্নিশের উপরে নামলাম। তারপর কতক্ষণ যে ওই কার্নিশেই দাঁড়িয়েছিলাম, এখন মনেও নেই। টানা এক–দেড় ঘণ্টা তো হবেই। এই গোটা পর্বটায় লোকেশ আমাদের বলেছে, কিচ্ছু চিন্তা কোরো না, শান্ত থাকো। পাশের বাড়ি থেকেও লোকজন দড়ি দিয়ে জল পাঠিয়ে আমাদের হেল্প করেছেন।

    অবশেষে দমকল কর্মীরা লম্বা মই এনে আমাদের উদ্ধার করে। পরে দেখা হলো আমাদের দুই ছেলে ও ভাইপোর সঙ্গে। আমরা ছ’জন ভালো আছি। লোকেশ এত বাচ্চা ছেলে। তবে এই ঘটনায় বুঝলাম, ও অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে। আজকে যে বেঁচে আছি, সেটা তো ওরই উপস্থিত বুদ্ধির জন্য। কিন্তু যত রাত গড়িয়েছে, ততই দেখেছি একে একে নিথর দেহ বাইরে বের করে আনা হচ্ছে। ওঁদের যদি কোনও ভাবে সাহায্য করতে পারতাম!

  • Link to this news (এই সময়)