‘যারা মমতার আঁচলের ছায়ায় বড় হয়ে করে খেতে বিজেপিতে এসেছে, তাদের থেকে দিলীপ ঘোষ বিজেপি শিখবে না!’ দিঘায় তোপ
আনন্দবাজার | ০১ মে ২০২৫
তিনি রাজনীতি ছাড়তে পারেন, তবে বিজেপি ছাড়ছেন না। দিঘায় বৃহস্পতিবার সকালে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে বললেন দিলীপ ঘোষ। বুধবার রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণে দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনে শামিল হয়ে দলের অন্দরে আক্রমণের মুখে পড়েছেন দিলীপ। সেই নিয়ে তিনি পাল্টা আঙুল তুললেন দলের সেই নেতাদের বিরুদ্ধে। নাম না করেই আক্রমণ করলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে। জানালেন, যাঁরা ‘মমতার আঁচলের ছায়ায়’ বড় হয়ে বিজেপিতে করে খেতে এসেছেন, তাঁদের থেকে তিনি বিজেপি করা শিখবেন না। মনে করিয়েছেন, তাঁর দলের নেতা তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘রাজনৈতিক সৌজন্য’-এর কথা।
বুধবার দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনে স্ত্রী রিঙ্কু মজুমদারকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন দিলীপ। রাজ্যের বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন সেখানে। তার পরেই বিজেপির কয়েক জন নেতা তাঁকে কটাক্ষ করেন। তালিকায় রয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। তিনি বলেন, কারও ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না। বুধবার জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের দিনে কাঁথিতে ‘সনাতনী সমাবেশ’ করেন শুভেন্দু। সেখানে না গিয়েই দিঘায় যান দিলীপ। তার পরেই দিলীপের নাম না করে শুভেন্দু বলেন, ‘‘কারও ব্যক্তিগত বিষয়, তাঁর মন্তব্য, তাঁর চলার ধরন, তাঁর কাজের ধরন, প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা, রাগ-বিরহ-দহন, এ সবের উত্তর আমি দিই না। ভবিষ্যতেও দেব না।’’ প্রসঙ্গত, দিন কয়েক আগে দিলীপের বিয়ের সময়েও একই সুর শোনা গিয়েছিল শুভেন্দুর গলায়। এ বার দিলীপ নাম না করেই পাল্টা খোঁচা দিলেন শুভেন্দুকে। বৃহস্পতিবার সকালে দিঘায় বললেন, ‘‘বড় বড় কথা কারা বলছেন? যাঁরা মমতার আঁচলের তলায় থেকে নেতা হয়েছেন। চরিত্রের কথা বলছেন কারা? যাঁরা কালীঘাটের উচ্ছিষ্ট খেয়েছেন, আজ বিজেপির উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে আছেন, তাঁরা দিলীপকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিচ্ছেন।’’ দিলীপের এই মন্তব্যের নিশানা যে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করা শুভেন্দু, তা এক প্রকার স্পষ্ট।
এর পরেই দিলীপ বিজেপির রাজনৈতিক সৌজন্যের কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি সেই পার্টি করি, যে পার্টির প্রধানমন্ত্রী (অটলবিহারী বাজপেয়ী) কালীঘাটে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন। মমতা তখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আজ শত্রু হয়েছেন বলে মানি না।’’ এর পরে নওয়াজ় শরিফের নাতনির বিয়েতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর পাকিস্তান যাওয়ার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। দিলীপ এ-ও জানিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কোনও ‘প্রোটোকল’ না মেনেই নওয়াজ়ের নাতনিকে বিয়েতে আশীর্বাদ করে এসেছিলেন। কারণ, এটাই বিজেপি। এর পরেই কটাক্ষের ধার বৃদ্ধি করে দিলীপ বলেন, ‘‘যাঁরা ২০২১ সালে এসেছেন, তাঁরা বিজেপি নিতে পারবেন না।’’ দিলীপের এই মন্তব্যের লক্ষ্য যে শুভেন্দু, তা স্পষ্ট। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আগে ২০২০ সালে বিজেপিতে যোগ দেন শুভেন্দু।
তবে দিলীপ এ-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, রাজনৈতিক সৌজন্য দেখালেও প্রয়োজনে ‘প্রত্যাঘাত’-এ পিছপা হবেন না তিনি। এ ক্ষেত্রে আবার বাজপেয়ী এবং মোদীর প্রসঙ্গই তুলেছেন। তিনি জানান, বাজপেয়ী বাসে চড়ে সৌজন্য সফরে ‘ঘোষিত শত্রু-দেশ পাকিস্তানে’ গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে আসার পরে যুদ্ধ হয়েছিল। তবে তিনি ভয় পাননি। সীমান্তে সেনা পাঠান। যুদ্ধে জয়লাভ করেন। একই ভাবে মোদীও প্রত্যাঘাতে ‘ভয়’ পাননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমার প্রধানমন্ত্রী মোদী শরিফের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন। তার পরে পাঠানকোট, পুলওয়ামা হামলা হয়েছিল। মোদী কিন্তু সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করতে ভয় পাননি।’’ দিলীপ জানিয়েছেন, বিজেপি আসলে এ রকমই। নাম না করে শুভেন্দুকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা অপসংস্কৃতি আনতে চাইছেন, তাঁরা বিজেপি জানেন না।’’ আর এই ‘অপসংস্কৃতি’-র জন্যই দল পিছিয়ে পড়ছে।
দিঘার মন্দিরের উদ্বোধনের দিনে দিলীপের উপস্থিতির পরেই জল্পনা তৈরি হয়েছিল যে, তিনি কি তৃণমূলের যোগ দিচ্ছেন? বিজেপির নেতাদের একাংশের মধ্যেও সেই জল্পনা শুরু হয়েছিল। এই জল্পনা নিয়েও মুখ খুলেছেন দিলীপ। তিনি জানিয়েছেন, যত দিন দলে ‘সন্দেহ’ ছিল না, তত দিন দল এগিয়েছে। যবে থেকে ‘অপসংস্কৃতি’ ঢুকেছে, পার্টি পিছোচ্ছে। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ নাম না করে কটাক্ষ করেছেন বিজেপির বর্তমান রাজ্যসভাপতি সুকান্তকেও। মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি বিজেপির রাজ্য সভাপতি থাকার সময়ে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক আসন পেয়েছে বিজেপি। তিনি বলেন, ‘‘২০২১ সালে বিজেপি তৈরি হয়নি। ২৫৭ জন শহিদ হয়েছেন। কারণ, আমার সময়ে তাঁরা প্রাণ দিয়েছেন। এর ফলে ৭৭ আসনে জিতেছি। আজ এক ডজন বিধায়ক চলে গিয়েছেন আমাদের ছেড়ে। সাংসদ চলে গিয়েছেন।’’ প্রসঙ্গত, সুকান্ত বুধবার স্পষ্ট করে দেন যে, দিলীপের দিঘা যাওয়াকে বিজেপি ‘অনুমোদন’ করছে না। সুকান্ত বলেন, ‘‘দল মনে করে, যে ভাবে মুর্শিদাবাদে হিন্দুরা মার খেয়েছে, যে ভাবে মন্দির ভাঙা হয়েছে, বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার পরে ওখানে (দিঘা জগন্নাথধাম) যাওয়া মানে সেগুলোকে অবজ্ঞা করা। তাই দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমরা কেউ ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাব না। উনি ব্যক্তিগত ভাবে গিয়েছেন।’’
একটা বিষয়ে দিলীপ স্পষ্ট করেছেন যে, বিজেপি তিনি ছাড়ছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু লোক হয়তো চাইছেন, আমি পার্টি ছাড়লে জায়গা খালি হবে, সুবিধা হবে। সুযোগ নেই। আমাদের লক্ষ্য, পশ্চিমবঙ্গে যত দিন না রাজনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে, এই লড়াই চলবে।’’ তিনি এ-ও জানান যে, কারও সঙ্গে কথা বললে যদি দল ছাড়া হয়, তা হলে সেই রাজনীতিকে তিনি ঘেন্না করেন। এর পরে না করে সৌমিত্র খাঁকেও কটাক্ষ করেছেন দিলীপ। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা চারটে বিয়ে করেন, ১৪টা গার্লফ্রেন্ড রাখেন, যাঁদের রাতের জীবন এক, দিনের জীবন এক, তাঁরা দিলীপ ঘোষকে ত্যাগী-ভোগী বলছেন!’’ দিলীপের দিঘা সফরের পরে বিষ্ণুপুরের বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র বলেন, ‘‘একজন ত্যাগী থেকে কী ভাবে ভোগী হতে হয়, তার আদর্শ নিদর্শন আপনি দিলীপবাবু। বাবুল সুপ্রিয় থেকে মুকুল রায়, এঁদের তাড়িয়ে আজ তাঁদের পথ অনুসরণ করছেন।’’ এই আবহেই দিলীপ বৃহস্পতিবার জানিয়ে দিলেন, তাঁকে কিছু বলতে হলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলা হোক। তিনি আগেও রাস্তায় ছিলেন। আগামী দিনেও থাকবেন।