দু’টো ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১৫ বছরের। তবু রুচিরা জালান এবং মনোজ পাসোয়ানের জীবনের শেষ কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যে আশ্চর্য মিল। ২৩ মার্চ ২০১০–এ দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা স্টিফেন কোর্টের চারতলা থেকে বাঁচার জন্য ‘যা থাকে কপালে’ ভেবে লাফ দিয়েছিলেন রুচিরা। এড়াতে পারেননি মাধ্যাকর্ষণকে।
প্রায় ৪০ মিটার নীচে পার্ক স্ট্রিটে আছড়ে পড়ে নিথর হয়ে গিয়েছিল তাঁর দেহ। ২৯ এপ্রিল ২০২৫–এ পার্কস্ট্রিট থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বড়বাজারে একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচতে হোটেল ঋতুরাজের তিনতলা থেকে একেবারে রুচিরার মতোই ‘যা থাকে কপালে’ ভেবে লাফিয়েছিলেন মনোজ। পরিণতি আলাদা কিছু হয়নি। ফুটপাথে আছড়ে পড়ে রুচিরার মতোই নিথর হয়ে গিয়েছে তাঁরও দেহ।
তফাৎ খালি তারিখে, ঘটনাস্থলে আর নামে। বাকি সবই এক। একই থাকে। কিছুই বদলায় না। না বদলায় পরিণতি, না বদলায় আশ্বাস, না বদলায় প্রশাসনের চূড়ান্ত অবহেলা। নিজেদের জীবনের ভুলতে না পারা এক অধ্যায়ের সঙ্গে হোটেল ঋতুরাজের ঘটনার অদ্ভুত মিল পাচ্ছেন ১৫ বছর আগের স্টিফেন কোর্ট ঘটনার ভুক্তভোগীরা।
স্টিফেন কোর্ট অনেকের জীবনে এমনই একটা ছাপ ফেলে গিয়েছে যে তার পর থেকে কোথাও অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে শুনলেই তাঁরা যেন টাইম মেশিনে ফিরে যান ১৫ বছর অতীতে। চোখের সামনে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ভেসে ওঠে সেই ছবি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরায় তোলা ছবি বিবর্ণ হয়। কিন্তু এই ছবি আজও টাটকা।
২০১০–এর ২৩ মার্চ সকালে ছেলেকে স্কুলের পুলকারে তুলে দিয়ে অন্য দিনের মতোই অফিস গিয়েছিলেন সত্যজিৎ সেনগুপ্ত। আর ফেরেননি। কয়েক ঘণ্টা পরে স্ত্রী সাধনা আতঙ্কিত, বিস্ফারিত চোখে টিভিতে দেখেছিলেন সেই অগ্নিকাণ্ডের খবর। বুধবার সাধনা ‘এই সময়’–কে বলেন, ‘তার পর থেকে আমি আর আগুন লাগার ঘটনা সহ্য করতে পারি না। মনে হয় আবার কারও পরিবার আমার মতোই বদলে যেতে চলেছে। আবার কেউ স্বামীকে, ছেলেকে, বাবাকে, বন্ধুকে হারালেন।’
সাজানো সংসার কয়েক মুহূর্তে শেষ হয়ে যাওয়ার পরে শূন্য থেকে সব কিছু শুরু করার লড়াই যে কত কঠিন আর নির্মম হতে পারে, সাধনা সেটা নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছেন। তিনি বলছেন, ‘যার যায়, একমাত্র সেই বোঝে। প্রশাসন শুধু পাশে থাকার ভান করে — কাজের কাজ কিছুই হয় না। শুধু কয়েক বছর পর পর নতুন নতুন অগ্নিকাণ্ড হয়।’
১৫ বছর আগের সেই দিনটা ইছাপুর নারকেলবাগানের বাসিন্দা শৈলেন বারিকের মনটাও চিরকালের জন্য বিষিয়ে দিয়েছে। ওই স্টিফেন কোর্টের আগুনেই শেষ হয়ে গিয়েছিলেন শৈলেনের একমাত্র ছেলে সৌরভ। শৈলেন ‘এই সময়’–কে বলেন, ‘ওই দিনটা কখনও ভুলব না। ছেলের কোনও খবর না পেয়ে খুঁজতে গিয়েছিলাম। শেষে হাসপাতালের মর্গে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে একটার পর একটা ট্রে টেনে বার করা হচ্ছিল। একটা ট্রে খুলতে দেখলাম সেখানেই শুয়ে আমার ছেলে।’
হোটেল ঋতুরাজের প্রসঙ্গে ১৫ বছর আগের সেই স্মৃতি নতুন করে স্থাণু করে দিয়েছে শৈলেনকে। সাধনার মতো তিনিও বলছেন, ‘প্রতিবার এমন ঘটনার পরে প্রশাসন উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি করে কয়েকদিন পরিদর্শন করে। তারপরে সব থেমে যায়। ওরা কেউ কথা রাখে না। সব নাটক।’
কথায় বলে সময় সব ভুলিয়ে দিতে পারে। সত্যিই একটা সময়ে সব ভুলে এগিয়ে যেতেই হয়। শরীরের ক্ষতচিহ্ন শুকিয়ে গেলেও অনেক সময়ে যেমন দাগ থেকে যায়, মনের আঘাতও তাই। সেই কারণেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় বড় প্রিয় মানুষটার চলে যাওয়ার খবর ছাপা পেপার কাটিংগুলো অথবা তাঁর ব্যবহার করা জিনিসপত্র প্রাণে ধরে ফেলা যায় না। সময়ের সঙ্গে এমন পেপার কাটিংয়ের সংখ্যা বেড়েই চলে। আর প্রতিবারই নতুন কেউ উপলব্ধি করেন, কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না। তার জন্য ৩৩ বছর অপেক্ষার প্রয়োজন হয় না।