• খাবার আনতে গিয়ে দম্পতির রক্ষা, আগুনে শেষ দুই সন্তান
    এই সময় | ০১ মে ২০২৫
  • দুই শিশু সন্তান, স্ত্রী আর শ্বশুরকে নিয়ে দেশ ঘুরতে বেরিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর বাসিন্দা টি প্রভু। চেন্নাই থেকে প্রথমে দিল্লি, সেখান থেকে সিকিম হয়ে দার্জিলিং। তারপর ফিরে যেতে চেয়েছিলেন বাড়িতে। কিন্তু ২০ বছর আগে কলকাতায় এসে তাঁর ভালো লাগার স্মৃতি ১০ বছরের মেয়ের কাছে এতবার গল্প করেছিলেন যে, এক রকম তার বায়নাতেই মাত্র এক দিনের জন্য ফেরার পথে এই শহরে এসেছিলেন তাঁরা।

    কিন্তু ভরা সংসার নিয়ে এলেও টি প্রভু এবং তাঁর স্ত্রী এম মধুরিমা চেন্নাই ফিরে যাচ্ছেন তিনটি কফিন বন্দি দেহকে সঙ্গে নিয়ে। তার মধ্যে দুটি তাঁদের সন্তানদের, একটি প্রভুর শ্বশুর অর্থাৎ মধুরিমার বাবার। মৃত্যুর আগে দমবন্ধ অবস্থায় কী কষ্টটাই না পেয়েছে এক রত্তি ছেলেমেয়ে দুটো, কলকাতা পুলিশ মর্গে বসে সে কথা ভাবতে ভাবতে বুধবার দুপুরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন প্রভু।

    বড়বাজারে হোটেল ঋতুরাজে সকাল সকাল চেক ইন করে শ্বশুর এস মুথুকৃষ্ণান(৬১), ১০ বছরের মেয়ে পি দিয়া, ৩ বছর ৮ মাসের ছেলে পি ঋতানকে নিয়ে কলকাতা ভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন প্রভু এবং মধুরিমা। বিড়লা মন্দির, কালীঘাট, হাওড়া ব্রিজ, নিউ মার্কেট ঘুরে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে আসেন তাঁরা। থার্ড ফ্লোরের ৩১৩ নম্বর রুমে মুথুকৃষ্ণানের কাছে দুই ছেলেমেয়েকে রেখে প্রভু আর মধুরিমা খাবার আনতে গিয়েছিলেন।

    কথা ছিল এক সঙ্গে ডিনার সেরে রাত পৌনে বারোটা নাগাদ হাওড়া স্টেশন থেকে চেন্নাই ফেরার ট্রেনটা ধরবেন তাঁরা। খাবার নিয়ে ফিরে এসে দেখতে পান জ্বলছে হোটেলটা। চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া।

    পুলিশ মর্গে বসে প্রভু বলেন, ‘আমি অনেকবার শ্বশুরকে ফোন করার চেষ্টা করি। কিন্তু কল ঢুকছিল না। কিছুক্ষণ বাদে দেখি আমার ফোনে শ্বশুরমশাই কল করছেন। বাচ্চারা কাঁদছে। উনি বললেন, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। চারিদিকে এতো ধোঁয়া। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। আমি বললাম, আপনি এখনই ঘর থেকে বেরিয়ে উপরের দিকে যান।’ এরপর অপেক্ষা না করে প্রভু নিজেই জ্বলতে থাকা হোটেলের ভিতরে ঢুকে পড়েন। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে কোনও রকমে দোতলা পর্যন্ত উঠে যান।

    ঘটনাচক্রে, সেই দোতলাই ছিল আগুনের এপিসেন্টার। প্রভুর কথায়, ‘এত আগুন, আর তার চাইতেও বেশি ধোঁয়া। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট ফেলেও কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। শ্বাস আটকে আসছিল। আমি নীচে নেমে আসি। মিনিট পনেরোর ব্যাপার। তারপর থেকে বার বার শ্বশুরকে ফোন করলেও উনি আর ফোন ধরছিলেন না। মনে হয় তততক্ষণে সব শেষ।’

    তবু মা–বাবার মন, শত আগুনে ঝাঁপ দিতেও ভয় করে না। প্রভু জানাচ্ছেন, হোটেলের বাইরে তখন একটি লম্বা মই (ল্যাডার) দেখতে পান তিনি। সেই মইতে উঠে পড়েন। থার্ড ফ্লোরে উঠে দেখেন একটি ঘর থেকে জানলার কাঁচ ভেঙে একজন নেমে আসছেন। তাঁকে বাঁচাতে নীচে নেমে যান তিনি। ফের ওঠেন উপরে।

    থার্ড ফ্লোরের ওই ঘরের ভিতরে ভাঙা জানলা দিয়ে ঢোকেন প্রভু। তাঁর কথায়, ‘ওটা সম্ভবত ৩০১ নম্বর রুম ছিল। আমি রুমের ভিতরে ঢুকে বুঝলাম কী দুর্বিসহ অবস্থা। এক ইঞ্চি দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করেছি বিশ্বাস করুন। কিন্তু পারিনি ৩১৩ নম্বর রুমে পৌঁছতে। এটা আমার ব্যর্থতা...!’ আর কথা বলতে চাননি তিনি। প্রতিনিয়ত নানা জায়গা থেকে কল এসেই চলেছে। প্রতিটি কল রিসিভ করেই প্রভু বলছেন, ‘আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে গেল...! কী নিয়ে থাকবো এবার আমরা?’

  • Link to this news (এই সময়)