• জমজমাট শিল্পাঞ্চলে এখন মরুভূমির রুক্ষতা
    এই সময় | ০১ মে ২০২৫
  • সুশান্ত বণিক, আসানসোল

    একটা সময় পর্যন্ত আসানসোল–দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল পরিচিত ছিল ‘ভারতের রূঢ়’ বলে। লৌহ–ইস্পাত শিল্প থেকে রেলইঞ্জিন কারখানা। কয়লাখনি থেকে টেলিফোনের কেবল তৈরির কারখানা। ছোট–বড় রিফ্যাক্টরি শিল্প থেকে সাইকেল তৈরির কারখানা। সবমিলিয়ে বৈচিত্রে ভরপুর।

    কর্মসংস্থানের নিরিখে এ সমস্ত কারখানায় প্রত্যক্ষ ভাবে কয়েক লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। পরোক্ষ ভাবে কর্মসংস্থান হয়েছিল আরও কয়েক লক্ষ মানুষের। বলা যায়, শহুরে অর্থনীতির সূত্রপাত তার হাত ধরেই। কিন্তু ভাটার টান শুরু হয় ৮০–এর দশকে। ধীরে ধীরে উৎপাদনে আকাল গ্রাস করে। শিল্পনগরী এখন মৃতপ্রায় মরুভূমি।

    একের পর এক রুগ্ন থেকে বন্ধ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। ঝাঁপ পড়েছে ইস্পাত ও কয়লা অনুসারী শিল্প কারখানায়। শ্রম দিবসের প্রাক্কালে তাই ভারাক্রান্ত শ্রমিকমহল।

    বন্ধ শিল্পের তালিকার প্রথম নাম পিংক্লিনটন কাচ কারখানা। বেলজিয়ামের গুণমান সম্পন্ন এই কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। আশির দশকের শুরুতে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনে সংস্থা বন্ধ করে দেন মালিকপক্ষ। কাজ হারিয়ে শূন্য হয়ে গেল শ্রমিক কর্মী আবাসন।

    ১৯৯৩ সালে প্রায় হাজার শ্রমিক কর্মীকে কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাবসর নিতে বাধ্য করায় রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্কো কারখানার কুলটি ইউনিটে ঝাঁপ পড়ে যায়। ২০০১ সালে কারখানার জমিতে জুটমিল বসাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ওই একই বছরে তালা পড়ে এশিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত সেন–র‍্যালে সাইকেল কারখানায়। কর্মচ্যুত হন প্রায় পাঁচশো শ্রমিক।

    টেলিফোনের কেবল্‌ তৈরির রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্তান কেবল্‌স বন্ধ হয় ২০১৬ সালে। বেকার প্রায় সাড়ে আটশো শ্রমিক–কর্মী। রেল ওয়াগন তৈরির রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বার্ন স্ট্যান্ডার্ড বন্ধ হয় ২০১৮ সালে। কর্মচ্যুতের সংখ্যা প্রায় ১২০০। ধাপে ধাপে তালিকায় নাম উঠেছে রানিগঞ্জ পেপারমিল, জেকে অ্যালুমিনিয়াম, ইন্ডিয়ান অক্সিজেন, ধাদকা নীল কারখানা এবং একাধিক কয়লাখনির।

    এক দিকে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, অন্য দিকে নতুন করে শিল্প গড়ে না–ওঠা। রাতারাতি বন্ধ্যাত্বের শিকার আসানসোল–দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল থেকে কর্মসংস্থান শব্দটাই উধাও! তিন দশক আগে শ্রম দিবস উপলক্ষে যে উৎসাহের জোয়ার দেখা যেত এ অঞ্চলে, এই মুহূর্তে সেখানকার ছবিটা রক্তাল্পতায় ধুঁকতে থাকা মরণাপন্ন রোগীর মতো। কেন এই বিবর্ণ পরিস্থিতি?

    আইএনটিইউসি–র কেন্দ্রীয় নেতা হরজিৎ সিং বলছেন, ‘এই শিল্পাঞ্চলে শেষ সরকারি বিনিয়োগ হয়েছিল ২০০৭ সালে। ইউপিএ–১ সরকার ইস্কোর পুনরুজ্জীবনের জন্য ১৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল। প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সেই শেষ!’ সিটুর জেলা নেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, বর্তমান নরেন্দ্র মোদী সরকারের শ্রমিক বিরোধী শিল্পনীতির প্রভাবে বন্ধ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি।

    ২০১৬ সালে রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্তান কেবলস কারখানার পুনরুজ্জীবন হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা আসানসোলের প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। ঘটনা হলো, তার ঠিক এক বছর পরেই কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। আইএনটিটিইউসির জেলা সভাপতি অভিজিৎ ঘটকের দাবি, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কারখানাকে রেলের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলেন। বিজেপি সরকারে আসার পরে ২০১৮ সালে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আসলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানার সঙ্কোচনই কেন্দ্রীয় সরকারের মূল লক্ষ্য।’

    যদিও অভিযোগ উড়িয়ে দলের রাজ্য সম্পাদক ও আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পলের বক্তব্য, ‘কেন্দ্রীয় সরকারই ইস্কো কারখানার দ্বিতীয় প্রকল্পের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। কাজ পাবেন অন্তত ৬ হাজার মানুষ।’ রাজ্য কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্রের আসানসোল বিভাগের জয়েন্ট ডিরেক্টর অনুজ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন,গত এক বছরে শিল্পাঞ্চলের একাধিক বেসরকারি সংস্থায় তাঁদের মাধ্যমে প্রায় ৩৭০ জন নিয়োগপত্র পেয়েছেন।

    কিন্তু ছবি কী পাল্টাল? এই শিল্পাঞ্চলে শ্রম দিবস নীরবে–নিভৃতেই কেঁদে চলেছে!

  • Link to this news (এই সময়)