জগন্নাথ (অর্থাৎ, ‘জগতের নাথ’ বা ‘জগতের প্রভু’) ভারতের ওড়িশা, ছত্তিশগড় (বস্তার অঞ্চল), পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, আসাম, মণিপুর ও ত্রিপুরা রাজ্যে এবং বাংলাদেশেও পূজিত হন। জগন্নাথ হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণু বা তার অবতার কৃষ্ণের একটি বিশেষ রূপ। তাঁকে তাঁর দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে পূজা করা হয়।
জগন্নাথের মূর্তি সাধারণত কাঠে তৈরি করা হয়। নিমগাছের কাঠ দ্বারা জগন্নাথদেবের প্রধান বিগ্রহগুলো (জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা) নির্মিত। এই মূর্তির চোখদুটি বড়ো বড়ো ও গোলাকার। হাত অসম্পূর্ণ। মূর্তিতে কোনো পা দেখা যায় না। বিগ্রহে অসম্পূর্ণ হাত ও পায়ের অনুপস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ এবং পবিত্র বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। জগন্নাথের পূজাপদ্ধতিও অন্যান্য হিন্দু দেবতাদের পূজাপদ্ধতির চেয়ে আলাদা।
ওড়িশা রাজ্যের পুরী শহরে জগন্নাথের প্রধান মন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দির হিন্দুধর্মের চারধামের অন্যতম। কোনো কোনো ওড়িয়া গ্রন্থে জগন্নাথকে বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে বুদ্ধের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। বিষ্ণুর রূপভেদ হিসেবে জগন্নাথ এক অসাম্প্রদায়িক দেবতা। তাকে এককভাবে হিন্দুধর্মের কোনো একটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করা যায় না। বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, স্মার্ত সকল শাখার অনুগামীরাই জগন্নাথকে পূজা করেন। এমনকি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গেও জগন্নাথের যোগ দেখা যায়।
জগন্নাথের সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসবটি হল রথযাত্রা। এই উৎসবের সময় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি মূল মন্দিরের (বড় দেউল) গর্ভগৃহ থেকে বের করে এনে কাঠের তৈরি তিনটি বিরাট রথে করে প্রায় ৩ কিলোমিটার (১.৯ মাইল) দূরে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভক্তরাই এই রথগুলো টেনে নিয়ে যান। যেখানেই জগন্নাথ মন্দির আছে, সেখানেই এই ধরনের রথযাত্রা আয়োজিত হয়।
‘জগন্নাথ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘জগৎ বা ব্রহ্মাণ্ডের প্রভু’। ওড়িয়া ভাষায় ‘জগন্নাথ’ নাম থেকে উৎপন্ন ‘জগবন্ধু’ শব্দটিরও প্রচলন লক্ষ্য করা হয়। এছাড়া জগন্নাথের মূর্তির গড়ন অনুসারে তার ‘কাল্য’ (অর্থাৎ, ‘কালো দেবতা’ বা ‘কালের দেবতা’), ‘দারুব্রহ্ম’ (অর্থাৎ, কাষ্ঠরূপী ব্রহ্ম), ‘দারুদেবতা’ (অর্থাৎ, কাঠের দেবতা), ‘চকাআঁখি’, ‘চকাডোলা’ বা ‘চকানয়ন’ (অর্থাৎ, যে দেবতার চোখ গোলাকার) নামও প্রচলিত।
ওড়িয়া ভাষার ‘নীলাদ্রি মহোদয়’ গ্রন্থে ‘দৈতাপতি’ নামে পরিচিত একটি অব্রাহ্মণ শ্রেণীকে নীলমাধবের পরম ভক্ত বিশ্বাবসুর বংশধর হিসাবে মেনে নেয়া হয়। তাঁরা পুরীর মন্দিরের কয়েকটি প্রধান দায়িত্ব পালন করেন— গুন্ডিচা যাত্রা, নবকলেবর, সপ্তাভরণ, শ্রীঅঙ্গ সেবা ইত্যাদি এবং ঈশ্বরের পরিবার নামে পরিচিত হন। আর বিদ্যাপতির বংশধরেরা পতি মহাপাত্র হিসেবে পরিচিত, রথযাত্রা ও নবকলেবরে তাঁদেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
হিন্দুদের ধর্মের কোনো কোনো সম্প্রদায় জগন্নাথকে বিষ্ণুর অবতার মনে করে। আবার কোনো কোনো সম্প্রদায়ে তাকে সকল অবতারের উৎস বিষ্ণু মনে করা হয়। মনে করা হয়, অবতারেরা সকল জাগতিক সৃষ্টির কারণ জগন্নাথের থেকে উৎসারিত। তাই রাম, কৃষ্ণ প্রমুখ অবতারের মতো জগন্নাথের কোনো জীবনবৃত্তান্ত বা লীলা নেই।
বিষ্ণুর (জগন্নাথ) সকল অবতার তাঁর থেকেই উৎসারিত এবং তাঁদের লীলা অবসানের পর জগন্নাথেই বিলীন হয়ে যান। ওড়িয়া কবিরা একসময় এই মতবাদই প্রচার করতেন। তাঁদের মতে, জগন্নাথ শূন্য পুরুষ, নিরাকার ও নিরঞ্জন। নীলাচলে লীলার জন্য তিনি সর্বদা উপস্থিত থাকেন। ওড়িশার পাঁচটি বৈষ্ণব শাখা তাঁদের ধর্মগ্রন্থে জগন্নাথকে (পুরুষোত্তম) পূর্ণব্রহ্মরূপে প্রচার করেন। তাঁরাও বলেছেন, জগন্নাথের থেকেই রাম, কৃষ্ণ প্রমুখ অবতারেরা উৎসারিত হয়ে জগতে লীলা করেছেন এবং লীলার অন্তে পূর্ণব্রহ্মে লীন হয়েছেন।
জগন্নাথের মধ্যে বিষ্ণুর সকল অবতারের চিহ্ন আছে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে তাকে বিষ্ণুর এক-একটি অবতারের মূর্তিতে পূজা করা হয়। বিভিন্ন প্রথা-রীতিনীতি থেকেও জগন্নাথের সঙ্গে নানা অবতারের যোগ লক্ষিত হয়। যদিও তাকে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত করা হয়ে থাকে।
পুরাণে আছে, বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার কাঠের স্তম্ভ ভেঙে বেরিয়েছিলেন। তাই জগন্নাথকে দারুব্রহ্ম রূপে নৃসিংহ স্তোত্র পাঠ করে পূজা করা হয়। জগন্নাথকে এককভাবে পূজা করার সময় বলা হয় ‘দধিবামন’। প্রতি বছর ভাদ্র মাসে জগন্নাথকে বিষ্ণুর বামন অবতারের বেশে পূজা করা হয়।।বার্ষিক রথযাত্রার সময়ও জগন্নাথকে বামন রূপে পূজা করা হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে তুলসীদাস পুরীতে এসে জগন্নাথকে রঘুনাথ (রাম) রূপে পূজা করেছিলেন। চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকে জগন্নাথকে কৃষ্ণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। আবার বিষ্ণুর নবম অবতার বুদ্ধকেও জগন্নাথ মনে করা হয়। যদিও বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে বুদ্ধের বদলে জগন্নাথকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াসটি বিতর্কিত। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, জগন্নাথ দায়িত্বশীল পুত্রের মতো তার সকল মানব অবতারের বাবা-মায়ের বাৎসরিক শ্রাদ্ধকার্য করে থাকেন।
জগন্নাথ মন্দিরে ভক্তদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথা কখনই ছিল না।হিন্দুধর্মের সকল সম্প্রদায়ে জগন্নাথের পূজা হয়। তিনি শুধু বৈষ্ণব দেবতা নন, সকল সম্প্রদায়ের দেবতা। জগন্নাথকে তান্ত্রিক ক্রিয়ার সার মনে করা হয়। শৈব ও শাক্তরা জগন্নাথকে দেবী বিমলার ভৈরব অর্থাৎ শিব মনে করেন। এমনকি জগন্নাথ মন্দিরের পূজারীরাও শাক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত। যদিও এই মন্দিরে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। বলরামকে শিব ও সুভদ্রাকে দুর্গা মনে করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, ভক্তদের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য জগন্নাথ যে কোনো দেবতার রূপ ধরতে পারেন। ভাগবত পুরাণে আছে, ঋষি মার্কণ্ডেয় পুরুষোত্তম জগন্নাথ ও শিবের একত্ব প্রমাণ করেন। মহারাষ্ট্রের গণপতি ভট্ট হাতিবেশের সময় জগন্নাথকে গণেশ রূপে পূজা করেছিলেন।
পৌরাণিক কাহিনি
জগন্নাথদেবকে কেন্দ্র করে দুটি জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত আছে। প্রথম কাহিনি অনুসারে, কৃষ্ণ তার ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তার মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তার সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তারা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্হিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ।
দ্বিতীয় কাহিনিটির অবতারণা করা হয়েছিল পূর্বোল্লিখিত উপখ্যানটির ব্যাখ্যা ও সংশয় নিরসনের উদ্দেশ্যে। বৃন্দাবনে গোপীরা একদিন কৃষ্ণের লীলা ও তাদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা আলোচনা করছিল। কৃষ্ণ গোপনে সেই সকল কথা আড়ি পেতে শুনছিল। কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকে নিয়োগ করা হয়েছিল গোপীরা যখন কৃষ্ণের কথা আলোচনা করে তখন কৃষ্ণ যেন তাদের নিকটবর্তী না হতে পারে সেদিকে নজর রাখার জন্য। কিন্তু গোপীদের কৃষ্ণপ্রীতি দেখে পরিতুষ্ট সুভদ্রা তাদেরই কথা শুনতে শুনতে বিমোহিত হয়ে যায়। দেখতে পায় না যে, তাদের দুই দাদা কৃষ্ণ ও বলরাম এগিয়ে আসছে। শুনতে শুনতে দুই ভাইয়ের কেশ খাড়া হয়ে উঠল, হাত গুটিয়ে এল, চোখদুটি বড় বড় হয়ে গেল এবং মুখে আনন্দের উচ্চ হাসির রেখা ফুটে উঠল। এই কারণেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এইপ্রকার রূপ। বৈষ্ণবরা কৃষ্ণের এই বিমূর্ত রূপটিকে পূজা করেন।