এই সময়: বিল্ডিং প্ল্যানের তোয়াক্কা না–করেই, অভ্যন্তরীণ নকশা বদলে হোটেল ব্যবসা চালাচ্ছিল মালিকপক্ষ। এমনকী, বড়বাজারে মেছুয়াপট্টির ছ’তলা ঋতুরাজ হোটলে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও ছিল না বলে নজরে এসেছে দমকলের। এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দোতলায় পানশালার জন্য প্লাইউড দিয়ে ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের সময়েই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে পুলিশ এবং দমকল।
ওই হোটেলে বিধ্বংসী আগুনে ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার পর্যন্ত তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা পুলিশ। বৃহস্পতিবার হোটেল মালিক আকাশ চাওলা এবং ম্যানেজার গৌরব কপুরকে গ্রেপ্তারির পরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কাজের বরাত পাওয়া ঠিকাদার খুরশিদ আলমকে পাকড়া করেছে লালবাজার।
তবে প্রশ্ন উঠছে, বিল্ডিং প্ল্যান বা ট্রেড লাইসেন্সের তোয়াক্কা না–করেই যদি শহরের প্রাণকেন্দ্রে এ ভাবে হোটেল চলে, তা হলে পুরসভা বা দমকল–পুলিশের নজরদারি কোথায়?
কোথা থেকে আগুন ছড়িয়েছে, তা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে মোটামুটি চিহ্নিত করে ফেলেছে পুলিশ–দমকল। কিন্তু, কী ভাবে আগুন লেগেছে, সে বিষয়ে একশো শতাংশ নিশ্চিত হতে চাইছেন তদন্তকারীরা। প্রাথমিক তদন্তে দু’টি তত্ত্ব সামনে এসেছে।
প্রথমত, ইন্টিরিয়ার ডেকোরেশনের কাজে আসা কর্মীদের কেউ সিগারেট অথবা বিড়ি খেয়ে ফেলে দেওয়ায় দাহ্য পদার্থ থেকে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, দোতলায় রান্নার কাজ চলার সময়ে গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্টের পরে বিপর্যয় ঘটে থাকতে পারে। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থল থেকে ইতিমধ্যে নমুনা সংগ্রহ করেছেন। দমকলের তরফে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
পাশাপাশি পৃথক স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করে তদন্ত করছে পুলিশ। সূত্রের খবর, খুরশিদ আলমকে গ্রেপ্তারের পরে জানা যাচ্ছে, দোতলায় প্লাইউডের কাজ করছিলেন ঠিকাদারের কর্মীরা। দোতলায় বিপুল পরিমাণে প্লাইউড এবং স্পিরিট জাতীয় দাহ্য বস্তু মজুত করা হয়েছিল। সে কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে হোটেলে।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, আগে ওই হোটেলটি বিয়েবাড়ির জন্য ভাড়া দেওয়া হতো। এক সময়ে হোটেলের দু’টি সিঁড়ি ব্যবহার করা হলেও, পরে শাটার দিয়ে একটি সিঁড়ির রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এ ক্ষেত্রেও বিল্ডিং প্ল্যানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই বছরের পর বছর অভ্যন্তরীণ নকশার বদল ঘটানো হয়েছে। কয়েকটি জানলাও বন্ধ করা হয়েছে। একাংশের অভিযোগ, বাইরে থেকে হোটেলটি এক রকম দেখালেও, ভিতরটা অনেকটাই বদলে গিয়েছিল।
বুধবার হোটেল মালিক আকাশ চাওলা এবং ম্যানেজার গৌরব কপুরকে আদালতে পেশ করা হলে তাঁদের ৮ মে পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। অন্য দিকে, এ দিন খুরশিদকে আদালতে পেশ করা হলে তাঁর আইনজীবী আদালতে দাবি করেন, ‘ওই হোটেলের মালিক বা কর্মী নন আমার মক্কেল। তিনি একজন ইন্টিরিয়র ডিজ়াইনার। ওয়ার্ক অর্ডার এবং পুরসভার লাইসেন্স আছে। গত ২০ অগস্ট থেকে হোটেলে কাজ চলছিল। প্রচুর দাহ্য পদার্থ এবং রান্নার জিনিসপত্র ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু রান্নার সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই।’
ওই আইনজীবীর সংযোজন, ‘ওই জিনিসপত্র থেকে আগুন লেগেছে বলে যে দাবি করা হয়েছে, তার ফরেন্সিক রিপোর্ট এখনও আসেনি। বেআইনি ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মক্কেলকে। আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য সব রকম ব্যবস্থা আছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব মালিক পক্ষের।’
পাল্টা সওয়ালে সরকারি কৌঁসুলি অবশ্য বলেন, ‘আগেই মালিক এবং ম্যানেজার গ্রেপ্তার হয়েছেন। দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে খুরশিদের নাম পাওয়া গিয়েছে। ওই জায়গার সম্পূর্ণ তাঁর কন্ট্রোলে ছিল। ওখান থেকে রান্নার সামগ্রী, গ্যাস সিলিন্ডার বাজেয়াপ্ত হয়োছে।’ দু’পক্ষের সওয়াল শোনার পরে খুরশিদকে ৭ মে পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক।