সুমন তেওয়ারি, আসানসোল: মৃত্যুই সত্য, আর সব মিথ্যা! এমন দার্শনিকসুলভ কথা আজ মাহির বাবা-মায়ের কাছে লৌহকঠিন বাস্তব। মেধাবী ছাত্রী ছিল মাহির। কঠিন রোগের সঙ্গে যুঝে বসেছিল মাধ্যমিকে। শুক্রবার মাহিরের মার্কসিট এসে পৌঁছয় স্কুলে। ঝকঝকে রেজাল্ট—৬৭৪। নেই শুধু মাহির! তার মেধা, মার্কশিট আজ কেবলই স্মৃতি! সবই যেন ‘মিথ্যা’। চোখের জল বাগ মানছে না বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমা। কাঁদছেন মাহির স্কুলের শিক্ষিকারাও। শোকে মূহ্যমান আসানসোলের ইসমাইল পাড়া।
মাহির মার্কশিটে নাম থৈবি মুখোপাধ্যায়। পরীক্ষার কিছুদিন আগে জন্ডিস ধরা পড়ে। অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ড্যামেজ হয় লিভার। পেটে ব্যথা, জ্বর, বমি। পরীক্ষাকেন্দ্রেও নিস্তার ছিল না। একটু লিখেই মাথা নামিয়ে নিতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও থৈবি বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভরসা দিয়েছিল খুব একটা খারাপ রেজাল্ট হবে না। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে সে। কিন্তু, জীবনের যুদ্ধ তাকে রক্ষা করেনি। রেজাল্টের দু’সপ্তাহ আগেই ভেলোরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় মাহির। গান, ছবি আঁকা, এমনকী বিজ্ঞান সেমিনারেও স্কুল ও জেলার মুখ উজ্জ্বল করেছে সে। অসুস্থ থেকেও এত ভালো রেজাল্ট। সুস্থ থাকলে মেধা তালিকায় পশ্চিম বর্ধমানের নাম প্রথমের দিকে থাকত। আত্মবিশ্বাসী ছিল শিক্ষা মহল।
ইসমাইল পাড়ায় মুখোপাধ্যায়দের পরিবারের ফুটফুটে মেয়ে মাহির। ঠাকুরদা বাসন্তীনাথ মুখোপাধ্যায় বড় সাধ করে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ‘বিপত্তারিণী’। সেই বিপত্তারিণীতে আজ থমকে সময়। বাড়ির দেওয়ালজুড়ে পেন্সিল দিয়ে মাহিরের আঁকিবুকি। বাবা বিবেক মুখোপাধ্যায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। মেয়ের লক্ষ্য ছিল এইমসের চিকিৎসক হওয়ার। বারবার বলত, ‘আই অ্যাম দ্য বেস্ট’, ‘আই ক্যান ডু ইট’, ‘আই অ্যাম এ উইনার’, ‘টুডে ইজ মাই ডে’, ‘গড ইজ অলওয়েজ উইথ মি’। এপিজে আব্দুল কালামের এই পাঁচটি বাণীই মূলমন্ত্র ছিঢ় মাহির। নজরুলগীতি ও ক্লাসিক্যাল গানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন পুরস্কার জিতেছে সে। ঘরজুড়ে জিতে আসা মেডেল, ট্রফি আর শংসাপত্র।
পশ্চিম বর্ধমান জেলার অন্যতম সেরা স্কুল আসানসোল উমারানি গরাই মহিলা কল্যাণ বালিকা বিদ্যালয়। এই স্কুলেই পড়ত মাহি। প্রতি ক্লাসেই প্রথম স্থান ছিল তার দখলে। সায়েন্স সেমিনারে বিজ্ঞানের মডেল বানিয়ে পুরস্কারও নিয়ে আসত। শিক্ষিকারা ভেবেছিলেন, বহুদিন পর থৈবির হাত ধরেই জেলায় আসবে মাধ্যমিকে নজরকাড়া সাফল্য। রাত ২টো-আড়াইটা পর্যন্ত বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে সাথ দেয়নি শরীর। নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়। মাধ্যমিক শুরুর দু’দিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে থৈবি। কোনওরকম বাড়তি সুবিধা না নিয়েই পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা শেষেই বিপর্যয়। মাহিকে প্রথমে হায়দরাবাদ, পরে ভেলোরে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানান, মাহির লিভার নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ১৬ এপ্রিল না ফেরার দেশে পাড়ি দেয় সে। মার্কসিট হাতে পেয়ে দাদু, ঠাকুমা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘কেন
এতটা চাপ নিলি থৈবি?’ স্কুলের টিআইসি পাঁপড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘থৈবি বাংলায় ৯৯, ইংরেজিতে ৯২, অঙ্কে ৯৮, পদার্থ বিজ্ঞানে ৯৭, জীবন বিজ্ঞানে ৯৮, ইতিহাসে ৯৫, ভূগোলে ৯৫ নম্বর পেয়েছে। আমাদের কাছে ও-ই সেরার সেরা!’ নিজস্ব চিত্র