এই সময়: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে হাসিমুখে বসে আছেন সস্ত্রীক দিলীপ ঘোষ। এই একটি ছবিই কার্যত আগুন জ্বালিয়েছে গেরুয়া শিবিরে। কার্যত গৃহযুদ্ধ তৈরি হয়েছে বঙ্গ–বিজেপির অন্দরে। দিলীপের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তোপ দাগতে শুরু করেছেন পদ্ম ব্রিগেডের একাংশ।
বিজেপির কারও ভবিষ্যদ্বাণী, দিলীপের তৃণমূলে যাওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা। কেউ আবার পুরোনো ঝাল মেটাতে বলছেন, ‘আমি তো আগেই দিল্লিকে সতর্ক করেছিলাম। এই লোকটা বাংলায় বিজেপিকে শেষ করতে চায়।’
বৃহস্পতিবার দিঘা থেকে ফেরার পথে পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটে বিজেপি কর্মীদেরই বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপকে। দলের ভিতরের আক্রমণ সামলাতে আপাতত একাই কাউন্টার অ্যাটাকে নেমেছেন দিলীপ।
তিনিও বুক বাজিয়ে বলছেন, ‘কেউ মানুক বা না মানুক, দিলীপ ঘোষ মানেই বিজেপি। দরকার হলে আমি রাজনীতি ছাড়ব, কিন্তু বিজেপি ছাড়ব না। এটা মমতা বন্দ্যোপাধায়ও জানেন যে, দিলীপ ঘোষ কোনও দিন তৃণমূলে যাবেন না। পার্টির কিছু লোক চাইছেন, আমি দল ছেড়ে দিই। যাতে আমার জায়গাটা খালি হয়। কিন্তু তার কোনও চান্স নেই।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপির এই আকচা–আকচি পোস্ট করে মিটিমিটি হাসছেন তৃণমূল নেতারা। যা দেখে দিলীপপন্থীরাও বিমর্ষ মুখে বলছেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে না–বসলেই ভালো করতেন দিলীপদা! তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঁর লড়াকু ইমেজটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে গেল।’
দিলীপ বিজেপির ‘আদি’ নেতা। তাঁর সঙ্গে ‘নব্য’ বিজেপির লড়াইটা নতুন কিছু নয়। তবে সেই লড়াইটা এতদিন রাজ্য বিজেপির চৌহদ্দির মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ ছিল। বুধবার দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনে দিলীপ হাজির হওয়ার পরে বিজেপির আদি–নব্য লড়াইটা কার্যত রাজপথে নেমে এসেছে। প্রকাশ্যেই দিলীপের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন অর্জুন সিং, তথাগত রায়, সজল ঘোষ, কৌস্তুভ বাগচির মতো বিজেপি নেতারা।
দিলীপের এই দিঘা–যাত্রাকে যে দল সমর্থন করে, না তা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য। তবে দিলীপ নিশ্চিত, এর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করতে পারবে না দল। তাঁর প্রশ্ন, ‘বিজেপি কাউকে বলতে পারবে, মন্দিরে যাবেন না! যে বিজেপির মজ্জায় মন্দির–সংস্কৃতি রয়েছে, সেই বিজেপি মন্দির বয়কট করতে বলবে কোন যুক্তিতে! সেটা তো সুইসাইড করার সামিল।’
তাঁর যুক্তি, ‘আমি তো ভগবান দর্শনে গিয়েছিলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি মন্দির বানিয়ে থাকেন, সেটাও তো আমাদের বড় জয়। এটা কেন দলের একাংশ বুঝতে চাইছে না।’
যদিও পদ্মের বড় একটি অংশ মনে করছে, গোটা দল যখন ঐক্যবদ্ধ ভাবে রাজ্যে ‘হিন্দুদের নিরাপত্তা’–সহ নানা বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তখন দিঘায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দিলীপের হাসি মুখে সময় কাটিয়ে আসা দলের নিচুতলার কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেবে। যার ফলশ্রুতিতে বৃহস্পতিবার রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় দিলীপের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান বিজেপি নেতা–কর্মীদের একাংশ। কোলাঘাটে তাঁর গাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখানো হয়।
মেদিনীপুরে দিলীপ ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতার গাড়ি ভাঙচুর করেন স্থানীয় বিজেপি কর্মীরাই। তথাগত রায় বলেন, ‘দিলীপ ঘোষ তৃণমূলে চলে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছেন। উনি যে ভাবে মমতার সঙ্গে সস্ত্রীক গল্প করলেন, তাতে বোঝাই যাচ্ছে, হয় তিনি তৃণমূলে চলে গিয়েছেন, অথবা কিছুদিনের মধ্যে চলে যাবেন।’
জবাবে দিলীপ বলেন, ‘তথাগত রায় পার্টিকে কী দিয়েছেন? একটা পঞ্চায়েত জেতাতে পেরেছেন? একটা কাউন্সিলার দিতে পেরেছেন?’ তথাগতর মতো অর্জুন সিংও দিলীপকে আক্রমণ করে বলেন, ‘দিলীপ ঘোষ তৃণমূলে চলে গেলে বিজেপিটা বাঁচবে। ২৬–এ আমাদের ক্ষমতায় আসার পথে কোনও বাধা থাকবে না। কর্মীরা যখন মার খান, উনি তখন বারমুডা পরে মাছ ধরেন। আমি তো দিল্লিকে আগেই সতর্ক করেছিলাম।’
সরাসরি কারও নাম না–করে দিলীপের জবাব, ‘আমার গাড়ি ভেঙে, আমাকে কালো পতাকা দেখিয়ে তো অনেকে তৃণমূলে নেতা হয়েছেন। তাঁরাই এখন বিজেপির নেতা। এটাই রাজনীতি। কিন্তু দলের কর্মীরা জানেন, কে গঙ্গাজল আর কে বেনোজল।’