• সাগর দত্তে মেদিনীপুরের ছায়া, প্রসূতি মৃত্যুতে তদন্ত কমিটি
    এই সময় | ০৩ মে ২০২৫
  • এই সময়: জানুয়ারিতে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে এক প্রসূতির মৃত্যু ও চার প্রসূতির গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার নেপথ্যে অভিযোগ উঠেছিল নিকৃষ্ট মানের রিঙ্গার্স ল্যাকটেটের দিকে। ঠিক তার চার মাসের মাথায় এ বার প্রায় একই ঘটনা ঘটল কামারহাটির কলেজ অফ মেডিসিন তথা সাগর দত্ত হাসপাতালে।

    মঙ্গলবার রাতে এক প্রসূতির মৃত্যু ঘিরে ফের চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তরে। রবি ও সোমবারে সিজ়ারের পরে একটি ইঞ্জেকশন দেওয়ার জেরে ১১ জন প্রসূতি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার মধ্যে মঙ্গলবার বিকেলে আইসিইউ–তে স্থানান্তর করতে হয় নিমতার পম্পা সরকারকে (৩৫)। ওই দিন রাতে মারা যান তিনি।

    এতবড় বিপত্তির নেপথ্যে সন্দেহের তির অ্যামিকাসিন নামে একটি অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশনের দিকে। ঝুঁকি না নিয়ে তাই বাতিল করা হয়েছে অ্যামিকাসিনের পুরো ব্যাচের ওষুধ–ই। উপাধ্যক্ষ তথা সুপার সুজয় মিস্ত্রির নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে সাত সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটিও। যদিও পম্পার দেহের ময়নাতদন্ত কেন করা হলো না, সে প্রশ্নও তুলেছে চিকিৎসকদের একাংশ।

    স্বাস্থ্যভবনের পক্ষ থেকে অবশ্য সাগর দত্তের ওই অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটিকে তেমন আমল দেওয়া হচ্ছে না। এই প্রসূতি মৃত্যুকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মঙ্গলবার রাতে সাগর দত্তে পৌঁছে যান রাজ্যের বিশেষ সচিব (স্বাস্থ্য–শিক্ষা) তথা ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য–শিক্ষা অধিকর্তা অনিরুদ্ধ নিয়োগী। শুক্রবার তিনি জানান, বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের পাঁচ জন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করছে স্বাস্থ্য দপ্তর। ময়নাতদন্ত প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, যেহেতু পম্পার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি এবং তাঁর পরিবারের তরফেও ময়নাতদন্তের কোনও দাবি তোলা হয়নি, তাই আইন অনুযায়ী ময়নাতদন্ত ছাড়াই দেহ তুলে দেওয়া হয়েছে তাঁদের হাতে। স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, 'অন্যান্য প্রসূতিরা এখন ভালো আছেন। কিন্তু একজন প্রসূতি কী কারণে মারা গেলেন, তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করবে স্বাস্থ্য দপ্তর।'

    একাধিক চিকিৎসক সংগঠন অবশ্য এই ঘটনা নিয়ে সরব হয়েছে। সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস বলেন, 'আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ভেজাল রিঙ্গার্স ল্যাকটেটের জেরে যে ভাবে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছিল ও চার জন প্রসূতি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সেই ধারা এখনও বদলায়নি রাজ্যে।' তাই সাগর দত্তের মর্মান্তিক ঘটনায় কাঠগড়ায় ওঠা অ্যামিকাসিন ইঞ্জেকশন–সহ যে সব ওষুধ ওই সব প্রসূতিদের উপরে প্রয়োগ করা হয়েছিল, তার নমুনা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন সরকারি চিকিৎসকদের আর এক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়।

    চিকিৎসক সংগঠন মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক বিপ্লব চন্দ্র বলেন, 'এই ঘটনার দায় সম্পূর্ণ ভাবেই রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরকে নিতে হবে। আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছি, মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে। ভেজাল ওষুধের ব্যবহার এবং বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রসূতি মৃত্যুর হারও বেড়েই চলেছে।'

    তাঁর দাবি, এই ঘটনায় যদি মেদিনীপুরের মতো ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে চিকিৎসায় অবহেলার নাম করে মৃত্যুর দায় ডাক্তার–নার্স–স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরে চাপিয়ে দেয় রাজ্য সরকার, তা হলে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে হাঁটবে তাঁদের সংগঠন।

    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাগর দত্তের এক চিকিৎসক বলেন, 'যে ভাবে রবিবার সিজ়ারের মাত্র দু' দিনের মধ্যে প্রবল শ্বাসকষ্ট, সেপসিস এবং মাল্টিপল অর্গান ফেলিয়োরে ওই প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে, তাতে ওষুধের বিষক্রিয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।' তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, একই রকম ঘটনা ঘটেছিল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজেও। পরে অবশ্য অভিযুক্ত ফ্লুইড প্রস্তুতকারক সংস্থাকে পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য দপ্তর।

  • Link to this news (এই সময়)