• পহেলগাম কাণ্ডকে মূলধন করে ভোটের অঙ্ক কষছে বিজেপি
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ০৩ মে ২০২৫
  • সৈয়দ হাসমত জালাল

    পহেলগাম কাণ্ডের বদলা নিতে প্রস্তুত ভারত। প্রয়োজনে যুদ্ধে নামতেও পিছপা নয়, তা সব বাহিনীর মহড়া ও প্রস্তুতি থেকেই বোঝা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথা অনুযায়ী, ভারতের ১৪০কোটি মানুষের রক্ত এখন ফুটছে পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাত করার জন্য। একজন প্রাক্তন বায়ুসেনা হিসেবে আমি আমার দেশের এই প্রস্তুতি ও পদক্ষেপকে সম্পূর্ণ সমর্থন করি। পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীরা যেভাবে ধর্মীয় পরিচয় দেখে হামলা চালিয়েছে, তার উদ্দেশ্য আসলে শুধুমাত্র আতঙ্ক সৃষ্টি করাই নয়, তাদের আরও গভীর উদ্দেশ্য হল– ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করা। এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করতে তারা যে খানিকটা সফল হয়েছে, তা আমাদের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে চোখ রাখলেই বোঝা যাচ্ছে। একজন ভারতীয় হিসেবে এই বিভাজন কখনোই কাম্য নয় বলে মনে করি।

    আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারত একদিন ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর নির্ভর করে। সে কথা আমরা মনে না রাখলেও পাকিস্তান তা ভুলতে দেয় না। তারা রাষ্ট্র হিসেবে তাদের সমস্ত রকম ব্যর্থতা থেকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতেই ভারতে বারবার হামলা চালিয়ে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে রাখতে চায়। ইদানিং আমাদের আর এক প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও এই একই জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেখানেও কট্টর ইসলামি মৌলবাদীরা এখন রাজত্ব করছে। স্বাভাবিকভাবেই তারাও সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করে নিজেদের ক্ষমতার গদিটি আরও মজবুত করতে চাইছে।

    কিন্তু ভারতের চরিত্র এবং মানসিকতা কখনোই পাকিস্তান বা সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশের মতো নয়। বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্মিলনে গড়ে উঠেছে ভারতের মূল চরিত্র ও ঐতিহ্য। এর সঙ্গে প্রতিবেশী ওই দুই দেশের কোনও তুলনাই চলে না, এ কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। একজন বায়ুসেনা হিসেবে শিখেছিলাম, ‘দ্য মোর ইউ সোয়েট ইন পিস, দ্য লেস ইউ ব্লিড ইন ওয়ার’। অর্থাৎ শান্তির সময় বেশি ঘাম ঝরালে যুদ্ধের সময় রক্ত কম ঝরে। এর অর্থ, যুদ্ধের প্রস্তুতিতে বেশি পরিশ্রম দিলে যুদ্ধে জেতাটা অনেক সহজ হয়। আর এ কথা তো সুবিদিত যে, যুদ্ধের প্রস্তুতিই যুদ্ধকে ঠেকিয়ে রাখে। সুতরাং পহেলগামের ঘটনায় এ প্রশ্ন উঠবেই, এখানে সে প্রস্তুতির অভাব কেন? কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী উভয়েই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, এক্ষেত্রে নিরাপত্তার কিছু গাফিলতি যেমন ছিল, তেমনি ছিল গোয়েন্দা ব্যর্থতাও। আসলে কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ইদানিং ভারত সরকারের একটা প্রবল আত্মসন্তুষ্টি সম্ভবত কাজ করছিল। আর সেখান থেকেই ঘটেছে এই গাফিলতি। প্রাক্তন মেজর জেনারেল জিডি বকশি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও বেদনাহত স্বরে প্রশ্ন তুলেছেন, সেনাবাহিনীতে গত তিন বছরে কেন এক লক্ষ আশি হাজার পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পে মাত্র চার বছরের চুক্তিতে সেনা নিয়োগ সেনাবাহিনীর মনোবলকে অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও প্রাক্তন সেনাকর্তারা পহেলগামে নিরাপত্তার গাফিলতির প্রশ্নটি তুলেছেন।

    উল্লেখ্য, পহেলগামে হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর সেখানে সেনা পৌঁছতে দু’ঘন্টারও বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। এই দেরির কোনও সদুত্তর মেলেনি। সে সময় কাশ্মীরের স্থানীয় বাসিন্দারাই আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ঘটনার পর থেকে যখন পর্যটকদের প্রাণভয়ে ফিরে আসার চেষ্টা চলছে, তখন ওই স্থানীয় অটোচালকরাই  বিনা পয়সায় আতঙ্কিত পর্যটকদের রেলস্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর অন্যদিকে বিমান ভাড়া পৌঁছে গিয়েছে ষাট হাজার টাকায়। এ কথা মানতেই হয়, স্থানীয় কিছু মানুষের সঙ্গে যোগসাজশ ছাড়া বাইরের জঙ্গিদের এতবড় কাণ্ড ঘটানো সহজ হতো না। কিন্তু তার জন্য নির্বিচারে সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের অথবা ভারতীয় মুসলমানদের দায়ী করা যায় না। অত্যন্ত সহজ ও যুক্তিগ্রাহ্য এই কথাটি আজ ভারতের বহু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। তার কারণ অবশ্যই বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রচার ও প্রভাব। আর তাই শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণেই হরিয়ানার এক বিরিয়ানি বিক্রেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি এই বাংলাতেও এক ‘হিন্দু’ মহিলা চিকিৎসক এক সন্তানসম্ভবা ‘মুসলমান’ রোগিণীর চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেন। এইসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, মানুষ কতখানি অসহিষ্ণু ও অযৌক্তিক হয়ে উঠেছে। এর জন্য বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছড়ানো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষই দায়ী। তাঁরা যে ভাষায় এই বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তা আমাদের দেশের সংবিধান সমর্থন করে না। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সুতরাং এ দেশের নাগরিক ধর্মনিরপেক্ষ হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই রাজনৈতিক নেতাদের সাম্প্রদায়িক প্রচারে প্রভাবিত বহু মানুষ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিকে গালাগালির পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছে।

    ধর্মের নামে যারা মানুষকে হত্যা করে, তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন, সেই হত্যাকারীদের ধিক্কার জানাই ও তাদের কঠিন শাস্তি কামনা করি। কিন্তু সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভোটে জেতার অঙ্ক কষছে বিজেপি, এ কথা আজ দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। এই রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই কোনোরকম বাকসংযম না রেখে যেভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তা আমাদের দেশের আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে কে? তাঁরা ভুলে যান, কাশ্মীরে পাকিস্তানি ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ভারতীয় সেনাকর্মী বাংলার সন্তান হাবিলদার ঝন্টু আলি শেখ। তাঁর দাদাও ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সুবেদার। পরিতাপের বিষয়, বঙ্গ বিজেপির সভাপতি এবং দেশের মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার সারা বাংলা চষে বেড়ালেও নদিয়ার তেহট্টে গিয়ে জঙ্গি হানায় নিহত ‘মুসলমান’ হাবিলদারের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেননি। আর যাই হোক, সেনাবাহিনীকে হিন্দু-মুসলমান হিসেবে ভাগ করা যায় না। আর যাঁরা তা করার কথা ভাবেন, তাঁরাই প্রকৃত দেশবিরোধী চিন্তার শরিক।

    অতি সম্প্রতি বনগাঁ সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানের পতাকা লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার ফন্দি আঁটতে গিয়ে পুলিশের হাতে যে দুই ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা দুজনই হিন্দু ঐক্য মঞ্চের কর্মী হিসেবে পরিচিত। তাঁদের নাম চন্দন মালাকার ও প্রজ্ঞাজিৎ মণ্ডল। গত বুধবার রাতে গোপালনগর থানা এলাকার আকাইপুর স্টেশনের শৌচাগারের পাশে পাকিস্তানের পতাকা লাগানোর কারণে ওই দু’জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশি জেরায় জানা গিয়েছে, তাঁদের পরিকল্পনা ছিল আরও অনেক বড়। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘হিন্দুস্তান মুর্দাবাদ’ ইত্যাদি স্লোগানও ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলিশের পক্ষ থেকেই এ কথা জানানো হয়েছে। যদিও বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠন হিন্দু ঐক্যমঞ্চ এ কথা অস্বীকার করতে চেয়েছে। কিন্তু এ বড় পুরনো খেলা। মাস খানেক আগেও দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে একটি মন্দিরে প্রতিমা ভাঙতে গিয়ে ধরা পড়েছেন বিজেপির দুই কর্মী কার্তিক ও সুরজিৎ।

    সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, অন্যায়ভাবে হলেও ‘হিন্দু’ আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে আগামী নির্বাচনে জিততে চাইছে বিজেপি। এমনকি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, পহেলগাম কাণ্ডের পর সরকারের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেন সেখানে উপস্থিত না থেকে বিহারে গেলেন নির্বাচনী প্রচারে। এর অর্থ পহেলগাম কাণ্ডের সর্বভারতীয় আবেগকে আসলে নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনে তাঁর দলীয় লাভের জন্য ব্যবহার করতে চাইছেন। কিন্তু সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা চাই, একদিকে পাকিস্তানি জঙ্গিদের হামলার উপযুক্ত জবাব দেওয়া হোক, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরেই এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ হোক। এই ভারতভূমি আমাদের পুণ্য তীর্থ, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রকবিতা স্মরণ করে বলি, ‘হেথায় দাঁড়ায়ে দু-বাহু বাড়ায়ে নমি নর-দেবতারে।’ হিন্দু-মুসলমান-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে ভারতের সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এর অন্যথা হলে তাতে ক্ষতি আমার দেশের, আমার দেশের মানুষের।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)