• শিল্পে উৎসাহ ছাড় প্রত্যাহার করল রাজ্য, নেপথ্যে কোন কারণ?
    আনন্দবাজার | ০৪ মে ২০২৫
  • শিল্পে সব ধরনের উৎসাহ ছাড় (ইনসেন্টিভ) দেওয়ার চালু সুবিধা প্রত্যাহার করল রাজ‍্য সরকার।

    এই সিদ্ধান্তের নেপথ‍্যে ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’ কল‍্যাণ তথা অনুদান, সামাজিক প্রকল্পগুলির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং সেগুলিকে আরও জোরদার করার উদ্দেশ্য রয়েছে বলে দাবি রাজ্য প্রশাসনের। ঘটনাচক্রে, যার মধ‍্যে সবচেয়ে বড় ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প। পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, রাজ‍্যের কোষাগারের বর্তমান পরিস্থিতিতে এখন ‘শ‍্যাম ও কুল’ রাখা কার্যত অসম্ভব হচ্ছে রাজ্যের পক্ষে। তাই শিল্পে এমন বিপুল খরচ ছেঁটে সামাজিক প্রকল্পগুলিতে টাকা জোগাড়ের চেষ্টাই এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট মহল প্রশ্ন তুলছে— তবে কি ২০২৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে শিল্পায়নের বদলে শুধু ‘জনমোহিনী’ পথকেই বেছে নিতে চাইছে নবান্ন। তা হলে, রাজ‍্যের শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের গতি রুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কাকরছেন তাঁরা। যদিও নবান্নের বক্তব‍্য, আরও উন্নত এবং সময়োপযোগী শিল্পনীতি সামনে আনবে রাজ‍্য। তাতে শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের পথ আরও সুগম হবে।

    যে কোনও রাজ‍্য বিনিয়োগ টানতে বিনিয়োগকারীদের কিছু আর্থিক সুবিধা (উৎসাহ ছাড়)-সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দান করে আসছে বহু কাল ধরে। এ রাজ‍্যও তার ব্যতিক্রম নয়। তাতে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও ভর্তুকি, সুদ-কর-ডিউটি ছাড়-সহ শিল্পে উৎসাহদানে নানা পদক্ষেপ থাকে। কিন্তু ভবিষ্যতে এ রাজ্যের শিল্প সংস্থাগুলি যে তার কিছুই দাবি করতে পারবে না, তা জানিয়ে দিয়েছে নবান্ন। এমনকী, এই নীতিতে অতীতের বকেয়া কিছু থাকলে, তা-ও যে শিল্পমহলের দাবির আওতায় আসবে না, আইন করে তা স্পষ্ট করা হয়েছে।

    প্রসঙ্গত এই ধরনের ‘উৎসাহ-ছাড়’ দিতে সরকারকে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়। প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, ১৯৯৩, ১৯৯৯, ২০০০, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৫ সালের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইনসেন্টিভ স্কিম’, ২০০৫ সালের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইনসেন্টিভ টু পাওয়ার ইনটেন্সিভ ইন্ডাস্ট্রিজ় স্কিম, ২০০৮ এবং ২০১৩ সালের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট সাপোর্ট ফর ইন্ডাস্ট্রিজ় স্কিম— সবই প্রত‍্যাহারের তালিকায় থাকছে। অর্থাৎ, বাম সরকারের সঙ্গে তার পরবর্তী এখনকার সরকারের সময়ের চালু শিল্প সহায়ক এই সুবিধাগুলি বাতিল হচ্ছে আগামী দিনে। অভিজ্ঞ এক কর্তার কথায়, “চালু ইনসেন্টিভ স্কিমের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে দীর্ঘদিন থেকেই। ফলে বকেয়ার পাহাড় জমছে। আর্থিক সমস্যাই এর অন্যতম কারণ। তাই এই সব সুবিধা প্রত্যাহার করা খুবই অর্থবহ।” তাঁর সংযোজন, “কিন্তু এই আইনের আগের প্রাপ্য অগ্রাহ‍্য কী করে করা হবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।”

    প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তার বক্তব্য, “শিল্প সংক্রান্ত নতুন নীতি তৈরি করছে রাজ‍্য সরকার, শিল্পমহলের সকলের মতামত নিয়েই। যাতে সেটায় ফাঁক বুজিয়ে আরও অনেক বেশি আধুনিক এবং সময়োপযোগী করা যায়। উৎসাহ-ছাড় সংক্রান্ত মতামতও নেওয়া হচ্ছে। সব দিক খতিয়ে দেখে তা কার্যকর করা হবে।” অন্য এক কর্তার কথায়, “শিল্পমহলের জন‍্য শিল্প তালুকে জমি, জমি ব‍্যাঙ্কের সুবিধা, জমি কিনে নিতে চাইলে সরকারি সহযোগিতা, শিল্পে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র এবং যে কোনও অনুমোদন-আবেদনের দ্রুত নিষ্পত্তি, যে কোনও সমস্যা সমাধানে সরকারি পদক্ষেপের মাধ‍্যমে পাশে থাকার বার্তা দিচ্ছে রাজ‍্য। শিল্প মহলকে সঙ্গে নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের সমন্বয় কমিটিও রয়েছে। ফলে যাবতীয় শিল্পবান্ধব পদক্ষেপ রাজ্য করছেই। এই অবস্থায় উৎসাহ-ছাড়ের বদলে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছনো গেলে বাজার অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। বাড়বে চাহিদা এবং তাতে বৃদ্ধি পাবে শিল্প সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড।”

    ‘উৎসাহ-ছাড়’ প্রত‍্যাহারের কারণ হিসেবে সরকারের অন্দরমহলের দাবি— এত দিন এই সুবিধা মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পসংস্থাই পেয়ে আসছে। ফলে শিল্প অগ্রগতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব সীমিত। অথচ এই নীতির কারণে রাজ্যের কোষাগারে বিপুল চাপ তৈরি হচ্ছে। এমনকি, যে শিল্পসংস্থাগুলি এই সুবিধা ভোগ করত, তাদের অনেকে কাজ শুরু করছে না। অনেকে হয় কাজ কমিয়ে দিয়েছে, না হয় চলে গিয়েছে ‘লিকুইডেশনে’। রাজ্যের দাবি, এই নীতি শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের উপযুক্ত অনুঘটক বলে প্রমাণিত হয়নি। তাই এই খাতে বিপুল বরাদ্দ কল‍্যাণ (অনুদান) প্রকল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পরিকাঠামো উন্নয়নে আরও ভাল ভাবে খরচ করা যায়। অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব আসবে তাতে।

    বিশ্লেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, এ রাজ্যে বেশির ভাগ অনুদান প্রকল্প চালু হয়েছিল কোনও না কোনও ভোটের আগে। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এবং খরচসাপেক্ষ প্রকল্প লক্ষ্মীর ভান্ডার। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে চালু হলেও, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে মহিলা উপভোক্তাদের মাথাপিছু মাসিক আর্থিক অনুদানের পরিমাণ বৃদ্ধি করে রাজ্য। কোষাগারের উপর তা যেমন বিপুল চাপ বাড়াচ্ছে, তেমনই ভোটে তার ইতিবাচক প্রতিফলন পেয়ে এসেছে শাসক দল। আগামী ভোটের আগেও এই প্রকল্পে উপভোক্তাদের অনুদান বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে, মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। কারণ, বিরোধী বিজেপি ইতিমধ্যেই বর্তমান রাজ‍্য সরকারের চেয়ে বেশি হারে লক্ষ্মীর ভান্ডার দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে। কিন্তু টানাটানির সংসারে রাজ্যের পক্ষে লক্ষ্মীর ভান্ডারের বরাদ্দ বাড়ানো কতটা সম্ভব, তা নিয়ে চর্চা রয়েছে প্রশাসনের অন্দরে। প্রসঙ্গত, রাজ‍্যের রাজস্ব এবং রাজকোষ ঘাটতি ঊর্ধ্বমুখী। চোখ রাঙাচ্ছে ঋণের বহর। এই অবস্থায় ‘উৎসাহ-ছাড়’ নীতি প্রত‍্যাহার তাৎপর্যপূর্ণ। এক কর্তার কথায়, “ভোটের আগে এ ভাবে অনুদান প্রকল্পে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা ইঙ্গিতপূর্ণ। চলতি আর্থিক বছরের বাজেটেও কন‍্যাশ্রী, স্বাস্থ‍্যসাথী-সহ একাধিক খাতে বরাদ্দ কমাতে হয়েছে রাজ‍্যকে। আর্থিক টানাটানিই তার অন‍্যতম কারণ।”

    বিশ্লেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, ‘উৎসাহ-ছাড়’ নীতিতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি। এ রাজ‍্যে সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানার বিনিয়োগ টানার নেপথ্যেও এই নীতি অনেকাংশে কাজ করেছিল। টাটাদের ওই কারখানা এখানে না হওয়ায় গুজরাত সরকার বিপুল সুবিধা ঘোষণা করে তা টেনে নেয়। এখন এ রাজ্যে এই নীতি প্রত‍্যাহার হলে বিনিয়োগকারীদের কাছে তা কী বার্তা নিয়ে যাবে, তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে। এ রাজ‍্যের মতো অনুদান প্রকল্প আরও কয়েকটি রাজ্যে চালু হয়েছে। কিন্তু সেখানে শিল্প সহায়তা ছাড় প্রত‍্যাহার হয়নি। এই অংশের আরও যুক্তি, একটি শিল্প স্থাপিত হলে তার সঙ্গে অনুসারী একাধিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়। তা ঘিরে প্রত‍্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে। শিল্প-সহায়তা বন্ধ হলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমতে পারে। সেই সূত্রে বাকি সব সুযোগও কমার আশঙ্কা থাকে।

    বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের (বিজিবিএস) মাধ্যমে বর্তমান সরকারের আমলে এ পর্যন্ত প্রায় ১৯ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের দাবি করছে রাজ্য। তার মধ্যে ১৩ লক্ষ কোটি টাকা কার্যকর করার দাবিও করা হচ্ছে। তবে আধিকারিকদের একাংশের দাবি, এই অগ্রগতি ‘উৎসাহ-ছাড়ের’ উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)