• ‘সহযোদ্ধা’ রিঙ্কুকে পেয়ে সুবিধা হল দিলীপের? না কি বেড়ে গেল জটিলতা? দিলীপ-জায়ার ভূমিকা নিয়ে চর্চার ঘূর্ণিপাকে পদ্মশিবির
    আনন্দবাজার | ০৪ মে ২০২৫
  • দু’সপ্তাহ আগে এক থেকে দুই হয়েছেন দিলীপ ঘোষ। দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনে বরাবরই পাশে অনেককে পেয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ ‘ঘরের’ ছিলেন না। গত ১৮ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এমন একজন দিলীপের জীবনে প্রবেশ করেছেন, যিনি ঘরেও পাশে, বাইরেও পাশে। তাতে কি দিলীপের সুবিধা হল? নাকি অসুবিধাও বাড়ল? বিজেপির অন্দরের চর্চায় কান পাতলে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন।

    দিলীপ নিজে বলছেন, ‘‘কোনও পরিবর্তন নেই। কোনও সুবিধাও হয়নি, কোনও অসুবিধাও হয়নি। দিলীপ ঘোষ একাই লড়তে পারে।’’ কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বলছে, দিলীপের কিছু সুবিধাও হয়েছে, কিছু অসুবিধার আভাসও মিলছে। সুবিধা এই যে, সহধর্মিনীকে দিলীপ সহযোদ্ধা হিসেবেও পাচ্ছেন প্রতি পদক্ষেপে। সবার সে সৌভাগ্য হয় না। আর অসুবিধার আভাস রয়েছে সহধর্মিনীর রাজনৈতিক পরিচয়ে। দিলীপের স্ত্রী রিঙ্কু নিজেও বিজেপি কর্মী। সেই ভূমিকা আর নেতার সহধর্মিনীর ভূমিকার মাঝে কোনও সঙ্ঘাত তৈরি হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। একটা ভূমিকার কারণে অন্যটা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

    বৃহস্পতিবার দিঘা থেকে কলকাতা ফেরার পথে দিলীপের সদ‍্যবিবাহিতা স্ত্রী রিঙ্কু মজুমদারের ভূমিকা অনেকের নজর কেড়েছে। কোলাঘাটে দিলীপ চা-চক্রে বসবেন স্থির করেছিলেন। সে চা-চক্র শেষ পর্যন্ত হয়নি। বিজেপি কর্মীদের বাধাতেই বিজেপির প্রাক্তন রাজ‍্য সভাপতির চা-চক্র ভেস্তে যায়। জেলা সভাপতিকে না জানিয়ে কেন দিলীপ কর্মসূচিতে হাজির হয়েছেন, সেই প্রশ্ন তুলে স্থানীয় বিজেপি কর্মীরা চা-চক্র আটকে দেন। বিজেপির সেই ঘরোয়া কোন্দল যখন প্রকাশ্য রাস্তায় চলছে, তখনই রিঙ্কু ‘সক্রিয়’ ভূমিকায় নজরে আসেন। বিক্ষোভরত নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি কথা বলতে এগিয়ে যান। দিলীপ না পারলেও তিনি বিক্ষোভ সামলে নেবেন, এমন একটা ভঙ্গি তাঁর ছিল। কিন্তু রিঙ্কু বিজেপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের শান্ত করতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, রিঙ্কুকে কোলাঘাটের বিক্ষোভরত কর্মীরা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে তাঁরা রাজি নন। ওই বিষয়টি রিঙ্কুর এক্তিয়ার বহির্ভূত।

    সত্যিই কি তাই? দিলীপের স্ত্রী হিসেবে না-হলেও দলের জেলা স্তরের কর্মী হিসেবে তো তিনি দলীয় বিষয়ে কথা বলতে‌ই পারেন? যেমন দিঘায় শুভেন্দু অধিকারী বা অন্য কারও নাম না-করে রিঙ্কু দলের এক শ্রেণির নেতাকে ‘ইমপোর্টেড’ নেতা বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ, যাঁরা অন্য কোনও দল থেকে বিজেপিতে এসেছেন। বিজেপির এক রাজ‍্য কমিটি সদস্যের কথায়, ‘‘উনি মূল দলের জেলা স্তরের কর্মী নন। কোনও একটি সেলের জেলা স্তরের পদাধিকারী। তাও তমলুক সাংগঠনিক জেলার নন। তাই কোলাঘাটে যখন ঘটনা ঘটছে, তখন সেখানে নাক গলানো তাঁর উচিত হয়নি।’‍’ তাঁর কথায়, “দিলীপদা আমাদের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি। প্রাক্তন সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। তাঁর কোনও পদক্ষেপের বিরোধিতা কেউ করে থাকতে পারেন। কিন্তু দিলীপদার সাংগঠনিক এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা নেই। রিঙ্কু মজুমদার তো তেমন কেউ নন।’‍’ বিজেপির ওই নেতার আরও বক্তব্য, “নেতার স্ত্রী বা পরিজন হওয়ার সুবাদে কেউ এক্তিয়ার বহির্ভূত ভাবে সাংগঠনিক বিষয়ে নাক গলাবেন, ওগুলো কংগ্রেসি ঘরানায় হয়। বিজেপিতে হয় না।”

    রিঙ্কুকে বছর দেড়েক আগে মহিলা মোর্চার দক্ষিণ কলকাতা সাংগঠনিক জেলার ‘ইনচার্জ’ করা হয়েছিল। তবে তার আগে পর্যন্ত রিঙ্কুকে মহিলা মোর্চার রাজ্য স্তরের নেতৃত্ব চিনতেন না। ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত রাজ‍্য মহিলা মোর্চার সভানেত্রী ছিলেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। তার পরে সভানেত্রী হন অগ্নিমিত্রা পাল। তিনি ২০২১ সালে রাজ‍্য দলের সাধারণ সম্পাদক হয়ে যাওয়ায় মহিলা মোর্চার দায়িত্ব যায় তনুজা চক্রবর্তীর হাতে। তনুজার পরে আসেন বর্তমান সভানেত্রী ফাল্গুনী পাত্র। বছর দেড়েক আগে পর্যন্ত রিঙ্কু মহিলা মোর্চা কর্মী হিসেবে এঁদের কারও পরিচিত ছিলেন না। এঁদের মধ্যে একজনের সঙ্গে ২০২৩ সালে নিউটাউনের এক দুর্গাপুজোর প‍্যান্ডেলে রিঙ্কুর আলাপ হয়েছিল বলে বিজেপির একটি সূত্রের দাবি। রিঙ্কু ওই পুজো কমিটির সদস্যা ছিলেন। বিজেপি সূত্রটি বলছে, রিঙ্কুর ছেলে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মহিলা মোর্চার ওই নেত্রীর সঙ্গে। সেই নেত্রীর কথায়, “ওঁর ছেলে আলাপ করিয়ে বলেছিল, মা বিজেপিকে পছন্দ করে।”

    রিঙ্কু অবশ্য বলছেন, তিনি ২০১৩ সাল থেকে দল করছেন! তবে বিজেপির এক রাজ‍্য কমিটির সদস্যের দাবি, “যত দূর মনে পড়ছে, ২০১৭-’১৮ নাগাদ উনি দলে এসেছেন।” তাঁর কথায়, “প্রথমে রাজারহাটে মণ্ডল স্তরের পদাধিকারী ছিলেন। পরে দলের হ‍্যান্ডলুম সেলে নেওয়া হয়। ওই সেলে তাঁকে জেলা স্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বৈঠকগুলোয় থাকতেন। নিজের গাড়ি নিয়েই নানা জায়গায় পৌঁছে যেতেন। চাঁদাও ভালই দিতেন।”

    নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজ‍্য স্তরের পদাধিকারীর ব‍্যাখ‍্যা, ‘‘বাবা-ছেলে বা মা-ছেলে বা বাবা-মেয়ে বা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দলে আছেন, এমন নমুনা বিজেপিতে অনেক পাবেন। দু’জনের মধ্যে একজন কোনও কারণে দলে কোণঠাসা হয়েছেন, তেমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। এমনকি, বাবা বহিষ্কৃত বা নিলম্বিত হয়ে গিয়েছেন, ছেলে দলে রয়েছেন, তেমনও খুঁজে পাবেন। কিন্তু কেউ নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে নিজের পরিবারের হয়ে দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, এমন খুঁজে পাবেন না।”

    রিঙ্কু অবশ্য বলছেন, ‘‘দিলীপ ঘোষের সহধর্মিনী হিসেবে আমার প্রতিবাদ করার এক্তিয়ার রয়েছে। আমার স্বামীকে আক্রমণ করা হবে আর আমি চুপ করে থাকব? তা আমি পারব না।’’ দিলীপ নিজেও এ বিষয়ে রিঙ্কুর পাশেই দঁড়াচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘‘ভারতীয় নারীর কাছে তাঁর স্বামী-সন্তানই সর্বাগ্রে। দল করেন, করেছেন, সে ঠিক আছে। কত দিন করবেন,কী ভাবে করবেন, সে পরে ভাবে যাবে। কিন্তু পরিবারের পাশে দাঁড়ানো অগ্রাধিকার। রিঙ্কু যা করেছেন, ঠিকই করেছেন।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)