• নেই দাওয়াই, রোগ সারছে না বছরের পর বছর! সঙ্কটে ১০৫ বছরের ইস্টবেঙ্গলের অস্তিত্ব, দায়ী কি নীতুর ‘সরকার-রাজ’
    আনন্দবাজার | ০৪ মে ২০২৫
  • ইমামি হটাও, ক্লাব বাঁচাও! এই স্লোগান যখন বাড়ছে, তখন পাশ থেকে আর এক দল সমর্থক গর্জে উঠলেন, ‘‘নীতুদা যত দিন থাকবে, কোনও ইমামি এসে কিছু করতে পারবে না।’’ আইএসএলের একটি ম্যাচে হারার পর যুবভারতীর বাইরে ইস্টবেঙ্গলের দুই গোষ্ঠীর সমর্থকের মধ্যে প্রায় হাতাহাতির জোগাড়!

    ‘নীতুদা’ অর্থাৎ ক্লাবকর্তা দেবব্রত সরকার। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে যাঁদের দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক, তাঁদের একাংশের মতে, নীতু আছেন বলেই ইস্টবেঙ্গল পরে হলেও আইএসএলে খেলার সুযোগ পেয়েছে। তিনি আছেন বলেই লাল-হলুদ জার্সি পরে ১১ জন ফুটবলার এখনও মাঠে নামতে পারেন। না হলে ক্লাব কবে বিক্রি হয়ে যেত! আবার অন্য এক অংশ মনে করেন, এ ভাবে ক্লাব চলতে পারে না। তাঁদের সাফ যুক্তি, বিনিয়োগকারী সংস্থা যখন বছরে কোটি কোটি টাকা ঢালছে, তখন দল তৈরি থেকে শুরু করে ফুটবল সংক্রান্ত সব কিছু তাদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। একই পরিবারে দু’জন কর্তা থাকলে খটাখটি লাগবেই।

    গত তিনটি আইএসএলে ধারাবাহিক ভাবে নবম স্থান ‘অর্জন’ করা ইস্টবেঙ্গলের মূল সমস্যা এটাই। গত চার বছর ধরে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল দল ক্লাব বনাম বিনিয়োগকারীর লড়াইয়ে ভুগছে। ট্রফি নেই। সমর্থকেরা মুখ ফেরাচ্ছেন। যুবভারতীতে মোহনবাগানের ম্যাচ থাকলে যেখানে গড়ে ২৫-৩০ হাজার দর্শক হয়, সেখানে ইস্টবেঙ্গলের ক্ষেত্রে মেরেকেটে ১০-১২ হাজার।

    ক্লাব-বিরোধীরা বুকে পাথর রেখে মাঝেমধ্যে ‘চিরশত্রু’ মোহনবাগানের উদাহরণ দিয়ে ফেলেন। গত দু’বছরের আইএসএল চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগানে তো এমন সমস্যা নেই? সেখানে তো সঞ্জীব গোয়েন‌্কার সঙ্গে ক্লাবকর্তা দেবাশিস দত্তের বিরোধ বাধে না? কট্টর ইস্টবেঙ্গলিরা যুক্তি দেন, মোহনবাগান তো বিকিয়ে গিয়েছে! গোয়ে‌ন‌্কাই তো এখন ফুটবল দলের মালিক। তাঁরা মনে করেন, ইস্টবেঙ্গল শতবর্ষের যে ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে, ‘কোম্পানির দল’ মোহনবাগান গোয়েন‌্কার হাতে পড়ে তা হারিয়েছে। সেই কারণে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেও ক্লাবে ট্রফি আনতে বার বার নাকি মালিককে অনুরোধ করতে হয়। শেষ পর্যন্ত ট্রফি শোভা পায় আলিপুরের ‘গোয়েন‌্কা নিবাস’-এই। তাঁদের দাবি, ‘নীতুদা’ আছেন বলেই ক্লাবটা এখনও উঠে যায়নি। আবার অনেকে মনে করেন, নীতু সরে গেলে ক্লাব বাঁচবে। রাজ্যের এক ইস্টবেঙ্গল অন্তপ্রাণ আমলা যেমন গম্ভীর ভাবে বলে থাকেন, ‘‘অফুরন্ত রসদ আর সময় কাটানোর উপাদান দিয়ে নীতু’দাকে কি প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া যায়? তা হলে অন্তত আমাদের ক্লাবটা বাঁচে!’’ কয়েক বছর আগে যুবভারতীতে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা ব্যানার ঝুলিয়েছিলেন, ‘দড়ি ধরে মারো টান, সরকার-রাজ খান খান।’ পুলিশ গিয়ে সেই ব্যানার খুলে দিয়েছিল।

    ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের অনেকেই মনে করেন, নীতু (সরকার) ক্লাবে ‘ছড়ি ঘোরান’ বলেই ধারাবাহিক ব্যর্থতা থেকে ক্লাব মুক্ত হচ্ছে না। কিন্তু তেমন হলে সদস্যেরা ধারাবাহিক ভাবে তাঁকে রেখেছেন কেন? আসলে গত দেড় দশক ধরেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রশাসন প্রায় বিরোধী-শূন্য। একটা সময়ে সুপ্রকাশ গড়গড়ি, পার্থ সেনগুপ্তেরা মাথা তোলার চেষ্টা করেও পারেননি। সিপিএমের মানস মুখোপাধ্যায়ও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছেন দলীয় কারণে। ফলে ‘ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে নিজের মতো পারিষদবর্গ বসিয়েছেন নীতু। ক্ষমতা ধরে রাখার প্রশ্নে সেটা তাঁর সাফল্যই।

    নীতু নিজে কী বলেন? তিনি সরে গেলে কি ক্লাব বাঁচবে? আনন্দবাজার ডট কম তাঁকে প্রশ্ন করেছিল। নীতু বলছেন, ‘‘আমি তো কোনও পদে নেই। আমি ক্লাবের একজন কর্তা মাত্র। তাই আমার থাকা বা সরে যাওয়াটা বিষয় নয়। বাকিদের থেকে আমার পরিচিতি একটু বেশি বলে হয়তো আমায় সামনে আসতে হয়। কিন্তু আমিও তো ক্লাবের অসংখ্য সমর্থকের সঙ্গে সমব্যথী। এটা ভেবে খারাপ লাগে যে, আমরা যখন দল গড়তাম তখন টাকা ছিল না। এখন টাকা আছে, কিন্তু আমাদের দল গড়ার ক্ষমতা নেই!’’

    জাতীয় লিগের নাম বদলে ‘আই লিগ’ হয়েছিল ২০০৭ সালে। আইএসএলে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল খেলার আগে পর্যন্ত সেটিই ছিল দেশীয় ফুটবলের এক নম্বর লিগ। কিন্তু ‘আই লিগ’ নাম হওয়ার পর সেই ট্রফি কখনও জেতেনি ইস্টবেঙ্গল। অর্থাৎ, ২০০৭ থেকেই ইস্টবেঙ্গলের ক্যাবিনেটে ‘ওজনদার ট্রফি’ নেই। মাঝে দু’টি ফেডারেশন কাপ জেতা ছাড়া। একটা সুব্রত ভট্টাচার্যের কোচিংয়ে। অন্যটা ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের কোচিংয়ে। সেই সুবাদেই এক বার এএফসি কাপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিল লাল-হলুদ। ব্যস, ওই অবধিই। এক কট্টর সমর্থকের কথায়, ‘‘আইএসএলের আগে পর্যন্ত টিম করতেন ক্লাবকর্তারাই। যাঁরা এখন বলছেন, দল গড়ার ক্ষেত্রে তাঁরা ভূমিকা নিচ্ছেন না বলে সাফল্য আসছে না, তাঁরা আসলে দীর্ঘ দিনের ব্যর্থতাকে সাম্প্রতিক ব্যর্থতা বলে চালাতে চাইছেন। নিজেদের ব্যর্থতাকেও আড়াল করতে চাইছেন।’’

    দীর্ঘ দিন ইস্টবেঙ্গল ভাল বিদেশি ফুটবলারকে এনে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। একটা সময় গ্যালারিতে সমর্থকদের চালু রসিকতা ছিল, একই কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারের চুলের ছাঁট বদলে বদলে তাঁকে বিমানবন্দরে নামানো হচ্ছে আর লাল-হলুদ জার্সি পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, যে ফুটবলারই আসুক, খেলা একই রকম থেকে যাচ্ছে। অথচ এই ইস্টবেঙ্গলই বেছে বেছে বিদেশি ফুটবলার আনার ক্ষেত্রে একদা ময়দানে দাপট দেখিয়েছে। মোহনবাগান জার্সিতে যখন চিমা ওকেরি বিধ্বংসী, তখন ২০০০ সাল নাগাদ ঘানা থেকে তিন ফুটবলার এনেছিলেন অধুনাপ্রয়াত ইস্টবেঙ্গল কর্তা স্বপন বল। জ্যাকসন, সুলে মুসা এবং ওপোকু। যাঁদের সামনে নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিলেন চিমা। গ্যালারিতে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আইলো ঘানা, চিমা কানা’। কিন্তু সেই স্বপনও নানা ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

    ইস্টবেঙ্গলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের ফুটবল বিষয়ক সমস্ত বিষয় এখন গোয়েন্‌কাদের হাতে। যা মোহনবাগানে আছে, তা ইস্টবেঙ্গলে নেই। সেটাকেই ‘সাফল্য’ হিসাবে দেখাতে চান কর্তারা। সমর্থকদের একটা অংশও ‘বিক্রি হইনি’ বলে শ্লাঘা বোধ করেন। কিন্তু সেই শ্লাঘায় কোনও ট্রফি জেতা নেই। সে কারণেই গত মরসুমে সুপার কাপ জয়কেই আঁকড়ে ধরে উৎসবে ভাসতে চেয়েছিল লাল-হলুদ জনতা। যে জনতা জানে, এখন আর ঘটি-বাঙাল (আইএসএলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান মিলিয়ে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা সাত) বা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল লড়াই হয় না। লড়াই হয় দুটো কোম্পানির। একটা কোম্পানি ৮০-৮৫ কোটি টাকার দল গড়ে। আর একটা কোম্পানি দল তৈরির জন্য ৪০-৪৫ কোটি টাকা ঢালে। যে ফারাক তুলে ধরে ক্লাবের একটা অংশ প্রশ্ন তুলছে, দুটোই কলকাতার সংস্থা। দুই মালিকই কলকাতায় ছোট থেকে বড় হয়েছেন। এক জনের ফুটবল দল নিয়ে এত আগ্রহ থাকলে অন্য জনের তা নেই কেন?

    তিন বছরে মোহনবাগান যে দু’বার ভারতসেরা হয়েছে। ইস্টবেঙ্গলের বড় অংশের সদস্য-সমর্থকদের এটাই আক্ষেপ। তাঁরা ক্লাব বনাম বিনিয়োগকারী লড়াই বোঝেন না, বুঝতে চানও না। তাঁরা ট্রফি দেখতে চান। তাঁরা চান, দিয়ামানতাকোস-নন্দকুমার-সৌভিকেরা ক্লাবকে ট্রফি এনে দিন। তাঁদের কাছে ইস্টবেঙ্গল মানে শুধু লাল-হলুদ জার্সি। ইস্টবেঙ্গল ট্রফি জিতলে তার কৃতিত্ব ক্লাবের না বিনিয়োগকারীর, সেই চুলচেরা বিশ্লেষণে তাঁদের আগ্রহ নেই।

    ইস্টবেঙ্গল যে অদূর ভবিষ্যতে কোনও ট্রফি জিতবে, সেটা এ পক্ষ, ও পক্ষ, নিরপেক্ষ কেউই মনে করছেন না। তবে সব পক্ষই এটা জানে যে, টাকার সমস্যা ইস্টবেঙ্গলে এখনই মেটার নয়। সাফল্য আসছে না বলে ইমামি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে আর রাজি নয়। আবার ক্লাবের বক্তব্য, টাকা না বাড়ালে ভাল দল গড়া সম্ভব নয়। তা হলে সাফল্য আসবে কী করে! সেখানেও আসছে মোহনবাগানের উদাহরণ। যেখানে গোয়ে‌ন‌্কার সংস্থা টাকা ঢালে। দলও তারাই গড়ে। তাঁদের অভিযোগ, ইস্টবেঙ্গলে অধিকাংশ ফুটবলারকে ‘গছিয়ে’ দেওয়া হয়।

    ইস্টবেঙ্গলে এই অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। আগের বিনিয়োগকারী ‘শ্রী সিমেন্ট’-এর সময়ও এই অভিযোগ উঠেছিল। ক্লাব কর্তৃপক্ষের ‘সামগ্রিক অসহযোগিতা’র কথাই বলেছিল তারা। তাদের বক্তব্য ছিল, দল তৈরির ক্ষেত্রে ক্লাবের থেকে কোনও সহযোগিতা তারা পায়নি। উল্টে নানা সময়ে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। শেষ পর্যন্ত হাতে তিন দিন সময় পেয়ে তারা দল তৈরি করেছিল। তার প্রভাব পড়েছিল আইএসএলে লাল-হলুদের খেলায়।

    শ্রী সিমেন্ট বলেছিল আর্থিক ক্ষতির কথাও। লাল-হলুদে তারা দু’বছরে ১০০ কোটি টাকার উপর বিনিয়োগ করেছিল। প্রথম বছরে ৫৫ কোটি টাকা। দ্বিতীয় বছরে তারও বেশি। এর মধ্যে আইএসএলে খেলার জন্য দিতে হয়েছিল সাড়ে ১৮ কোটি টাকা, দল তৈরিতে লেগেছিল প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকা, কোচিং স্টাফদের আনতে প্রায় চার কোটি টাকা, বিমায় লেগেছিল এক কোটি, মাঠ তৈরিতে প্রায় ২৫ লক্ষ, সমাজমাধ্যম পরিচালনা করতে ৭৫ লক্ষ, দলের গোয়া যাওয়া এবং সেখানে বিভিন্ন কর্মীদের রাখার জন্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এর সঙ্গে হোটেলে দলকে রাখার জন্য দিতে হয়েছিল প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। শ্রী সিমেন্ট নাকি ওই দু’বছরে ‘রিটার্ন’ পেয়েছিল খুব বেশি হলে ১৪ থেকে ১৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে স্পনসরশিপ থেকে ৪০-৫০ লক্ষ। বাকিটা আইএসএল খেলে। শুধু তা-ই নয়, চলে যাওয়ার পর ফুটবলারদের বকেয়াও তাদেরই মেটাতে হয়েছিল। শোনা যাচ্ছে, ইমামির ক্ষেত্রে বার্ষিক বিনিয়োগ সব মিলিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা। ক্ষতির পরিমাণ শ্রী সিমেন্টের থেকেও বেশি।

    অথচ কলকাতা ময়দানে প্রথম বার বড় মাপের বিনিয়োগকারী এনেছিল ইস্টবেঙ্গলই। ২০১৮ সালে তারা চুক্তি করেছিল ‘কোয়েস’ সংস্থার সঙ্গে। এর ফলে ক্লাবের অর্থের সংস্থান বেড়েছিল। ভাল মানের ফুটবলারও নিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। সেই মরসুমে আই লিগে খারাপ খেলেনি তারা। অল্পের জন্য ট্রফি জিততে পারেনি যদিও। কিন্তু কোয়েসের সঙ্গেও ক্লাবকর্তাদের বনিবনা হয়নি। দু’বছর পরেই বিচ্ছেদ। এর পরে শ্রী সিমেন্টই হোক বা ইমামি, ইস্টবেঙ্গলের বিনিয়োগকারী পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যা চেয়েছেন, তা-ই হয়েছে। এ বারও তার অন্যথা হবে না। লাল-হলুদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরে এক বছরের মধ্যেই সরে যেতে চেয়েছিল শ্রী সিমেন্ট। শেষ মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই থেকে গিয়েছিল তারা। দ্বিতীয় বছরে অবশ্য কোনও অনুরোধ-উপরোধে কাজ হয়নি। শোনা গেল, বঙ্গ বিজেপির বড় মাপের এক জন নেতাও নাকি সেই সময় তদ্বির করেছিলেন শ্রী সিমেন্টের কাছে। কিন্তু ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিপত্রে সই না হওয়ায় শ্রী সিমেন্ট শুধু ‘টার্মশিটে’র উপর ভিত্তি করে থাকতে চায়নি। ক্লাবও নাছোড় ছিল— শ্রী সিমেন্টের দাবি মানা সম্ভব নয়। তাদের বক্তব্য ছিল, এই শর্তগুলো মেনে নেওয়া মানে ক্লাবকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া। ক্লাব কেন তার স্বত্ব বিক্রি করে দেবে? ক্লাবে প্রাক্তন ফুটবলার, সদস্য, সমর্থকদের ঢুকতে দেবে না, এমন কথা ‘বিনিয়োগকারী’ কী করে বলতে পারে? কারণ হিসাবে কর্তাদের বক্তব্য ছিল, দল করতে পারেনি। রোজ হারছে। সদস্য-সমর্থকদের রাগের পারদ চড়ছে। তাই তাদের ক্লাবে ঢুকতে না দিয়ে ‘দায়’ এড়াতে চাইছে।

    এর পরে ইমামির আগমনও মুখ্যমন্ত্রী মমতার হাত ধরেই। মমতা একাধিক বার সে কথা বলেওছেন। গত সপ্তাহে ইস্টবেঙ্গলের তথ্যচিত্রের উদ্বোধনে এসেও তিনি বলেছিলেন, ‘‘মোহনবাগানের টাকার সমস্যা নেই। সঞ্জীব গোয়েন‌্কা দেখছেন। ওঁর টাকার অভাব নেই। ইস্টবেঙ্গলের ইনভেস্টর দরকার ছিল। আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।’’

    মুখ্যমন্ত্রী বিনিয়োগকারী এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু তিনি তো আর দল গড়ে দেবেন না! মাঠে নেমে ফুটবলও খেলবেন না! ফলে ব্যবস্থা হলেও ফল হয়নি। ময়দানে শোনা যাচ্ছে, ফুটবল দল চালানোর জন্য যতটা টাকা ঢালা দরকার বা মোহনবাগানের জন্য যে অর্থ সঞ্জীব গোয়েন‌্কা বিনিয়োগ করেন, তার ধারেকাছেও যেতে চাইছে না ইমামি। তাদের যুক্তি, দল যেখানে ম্যাচের পর ম্যাচ খারাপ খেলছে, সেখানে বেশি টাকা ঢেলে কী হবে? আবার ক্লাবের একাংশের পাল্টা যুক্তি, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে না বলেই ভাল দল গড়া যাচ্ছে না। দল ডুবছে। ‘নীতুদা’ এর মধ্যে একাধিক বার বৈঠক করেছেন ইমামির কর্তাদের সঙ্গে। তিনি আশাবাদী, ইমামি আরও টাকা বিনিয়োগ করবে। আনন্দবাজার ডট কমকে সেই আশার কথাই শুনিয়েছেন ময়দানের নীতু।

    তথ্যচিত্র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ক্লাবের সঙ্গে ইমামি-কর্তাদের তেমন বনিবনা না থাকার কথা তাঁর গোচরে আছে। খানিকটা ধমকের সুরেই তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার একটা ক্ষোভ আছে। ইমামি ক্লাবকে অনেক সাহায্য করছে। কিন্তু এগোতে গেলে ভাল ফুটবলার লাগে। এখানেই আমি ক্লাবকে বলব, আপনারা সঠিক পরামর্শ না দিলে ওঁরা এগোবেন কী করে? সবচেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন তো সমর্থকেরা। ক্লাবকর্তাদেরও এগোতে হবে। আমার মনে হয় না, ইমামি সাহায্য করছে না। ওরা তো টাকা দিচ্ছে! কিন্তু তার বদলে ওদের ট্রফিটা তো দিতে হবে। অন্তত সেই চেষ্টা করতে হবে।’’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাবের সাফল্যের উদাহরণ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ‘‘শুধু টাকা ঢাললে হবে না। বুদ্ধি করে দলটা তৈরি করতে হবে। নীতুদাকে বলছিলাম, আপনারা দলটা ভাল করে করছেন না কেন? ডায়মন্ড হারবারকে দেখে শিখুন। ওদের দেখে বুঝুন, কেমন বুদ্ধি খাটিয়ে দল গড়েছে। ইস্টবেঙ্গলের কর্তারাও আগে থেকে ভাবুন, কাদের নেবেন। এক বছর ধরে পরিকল্পনা করুন। কঠোর সিদ্ধান্ত নিন। আগামী বছর যেন আর ব্যর্থতা না আসে।’’

    রবীন্দ্র সদনের মঞ্চে তখন ছিলেন নীতু ‘সরকার’। ছিলেন ইমামির আদিত্য আগরওয়াল। মঞ্চ এক হলেও দু’পক্ষের বনিবনা হবে? মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রশমিত হবে? ইস্টবেঙ্গলে কি ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’ চালু হবে? ‘সরকার-রাজ’ শেষ হবে? না কি ১০৫ বছরের প্রাচীন ক্লাব যাবে বানপ্রস্থে?
  • Link to this news (আনন্দবাজার)