• ঘুঙুরের বোলে সব প্রশ্ন উড়িয়ে ছেলের অ্যাকাডেমিক ডিলিট
    এই সময় | ০৪ মে ২০২৫
  • ‘ছেলে হয়ে নাচিস?’ এই প্রশ্নের মুখে ওঁকে পড়তে হয়েছে বহু বার। এই প্রশ্নে অভ্যস্ত গিয়েছেন ছোট থেকেই। তিনি নিজেই বলছেন, ‘ভালো করে অ–আ বলার আগেই ধা–ধিন–ধিন–ধা–র তালে নাচতে শিখেছি।’ তবু প্রশ্ন পিছু ছাড়ে না। প্রশ্ন আর অবহেলা উপেক্ষা করেই নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন সুগত দাশ। শুধু এগিয়ে চলাই নয়, নাচ নিয়ে লেখাপড়া আর ভরতনাট্যম ও রবীন্দ্র নৃত্যকেই কেরিয়ার করেছেন তিনি। এরই স্বীকৃতি হিসেবে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাডেমিক ডিলিট ডিগ্রি পেয়েছেন।

    সুগত ও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগের অনেকেরই দাবি, বরীন্দ্র ভারতীতে নৃত্য বিভাগ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রথম কেউ এই অ্যাকাডেমিক ডিলিট পেলেন। এ তো গেল স্বীকৃতির দিক। এর একটা অন্য দিকও রয়েছে। তথাকথিত ‘মেয়েলি’ শিল্পে পুরুষ হিসেবে সুগতর এই কৃতিত্বকে অন্য গুরুত্বের চোখে দেখছেন অনেকেই। কারণ, নাচকে যাঁরা এখনও ‘মেয়েদের সাবজেক্ট’ হিসেবেই দাগিয়ে দেন, তাঁদের মুখের উপরে সুগত জবাব দিয়েছেন— এমনটাও বলে মনে করছেন অনেকে।

    দমদমের দুর্গানগরের বাসিন্দা সুগতর বাড়িতে শুরু থেকেই একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রয়েছে। মা শিখা দাশ সঙ্গীতচর্চা করেন। তাঁর একটি নাচ ও গানের স্কুল রয়েছে। সেই স্কুলেই ছোট থেকে নৃত্য–শিক্ষার পাঠ শুরু। স্কুলের বন্ধুরা যখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যাঙ্কিংয়ের চাকরির পড়াশোনার প্ল্যান করছেন, নৃত্য–রঙ্গে বিভোর সুগত ভেবে নেন নাচ নিয়েই পড়বেন। নাচেই গড়বেন কেরিয়ার। বন্ধুরা অনেকে হেসেছে, স্বল্প–পরিচিতরা কটাক্ষ করেছে। তবু দমেননি সুগত। রবীন্দ্র ভারতী থেকেই নৃত্যে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি করেছেন। গবেষণার কাজে একটা সময়ে থেকেছেন ইউকে–তেও। পাকাপাকি ভাবে লন্ডনে থাকার অফার থাকলেও বাংলার টানে ফিরে এসেছেন ঘরে।

    সুগত বলছেন, ‘অনেকেই আমার নাচটাকে আমার অনেক কিছু না–পারার জন্য দায়ী করেছেন। মানে, আমি ধরুন অঙ্ক কষতে পারছি না, আমাকে বলা হতো, এত নাচলে অঙ্ক করবি কী করে? হয়তো আমি ভালো করে খেলতে পারছি না, তখন কটাক্ষ এসেছে, আমি নাচি, তাই খেলতে পারি না।’ আবার অনেক সময়েই সুগত নাচেন বলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে তাঁর ‘পৌরুষ’। তাঁর কথায়, ‘এমনও শুনেছি আমি কি আদৌ ছেলে? অনেকে দিন–রাত এক করে ফেলেছে আমার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়েও। কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি। পোস্ট ডক্টরেট করার জন্য ইউএসএ থেকে অফার পেয়েছিলাম। তবে শুভাকাঙ্ক্ষীরা বললেন, চাইলে আমি রবীন্দ্র ভারতী থেকেও সেটা করতে পারি।’ রবীন্দ্র–নৃত্যের সমাজের নানা প্রচলিত দিককে কী ভাবে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে, সেটা নিয়েই ডিলিটের জন্য গবেষণা করেছেন সুগত।

    রবীন্দ্র ভারতীর ক্লাসেও সুগতরা ছিলেন ‘সংখ্যালঘু’। ৫৬ জনের ক্লাসে ৫০ জনই মেয়ে। কখনও বাড়ি থেকে আপত্তি আসেনি? তাঁর কথায়, ‘পড়াশোনা নিয়ে আমার বাড়ি কখনও আপত্তি করেনি। আমার দাদা মেটালার্জি নিয়ে পড়াশোনা করে এখন আইআইটিতে পড়ান। একটা সময়ে বুঝতে পারতাম, মা–বাবা সকলেরই আমাকে নিয়ে প্রবল চিন্তায়। একে তো চাকরি নেই। তার উপরে নাচ! আমার কী হবে, তা নিয়ে ওঁরা এখনও বেশ চিন্তিত।’ সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটিতে এখন পারফর্মিং আর্টস পড়ান সুগত। যে সময়ে তিনি এই ডিলিটের আবেদন করেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী।

    তাঁর কথায়, ‘ওই বিভাগ থেকে সম্ভবত এই প্রথম কেউ ডিলিট পেলেন। তার উপরে সুগত একজন পুরুষ। বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের হাতে এই নৃত্য বিভাগের সূচনা হয়েছিল। এতগুলো বছর পরে যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো।’ বিভাগের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান মাধুরী মজুমদার বলছেন, ‘অনেক দিন ওঁর ফাইলটা বিভাগেই পড়েছিল। ওঁর কাজ শেষ হওয়ার পরেও সেটা ক্লিয়ার হচ্ছিল না। একাধিকবার ওঁকে দেখেছি সেটার জন্য ঘুরে বেড়াতে। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পরে আর সেটা আটকে রাখিনি। কষ্ট করে উনি এটা অর্জন করেছেন। কেন আটকে রাখব!’ সৃজনশীল নৃত্যশিল্পী কোহিনূর সেনবরাট বলেন, ‘২০২৫–এ দাঁড়িয়ে মেয়েদের কাছে বিষয় হিসেবে নৃত্য যতটা মেনস্ট্রিম, ছেলেদের কাছে আদৌ নয়। এটা শুধুমাত্র একটা ডিগ্রি পাওয়া নয়। সুগত ধারণাটাকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবেন।’

  • Link to this news (এই সময়)