সঞ্জয় চক্রবর্তী
আবাসন বলতে যা বোঝায়, হুবহু তাই। ৮-১০টি বহুতলে সাজানো। ৯৬টি ফ্ল্যাট। অর্ধেক বহুতলের গ্রাউন্ড ফ্লোর ব্যবহার করা হয় পার্কিং হিসেবে। ছোট্ট একটি সাজানো গোছানো পার্কও রয়েছে। আবাসনের ভিতরে রাস্তার পাশে সাজানো গোছানো ফুলের বাগান। ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের ব্যবস্থা বাসিন্দাদের জন্য। সিসিটিভিতে মোড়া পুরো এলাকা। তার বাইরে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তারক্ষীরা পাহারা দেন। একেবারে ঝকঝকে তকতকে। নেই কেবল লিফট। আসলে ২১ বছর আগে কেউই ভাবেননি যে আবাসনে লিফট কতটা জরুরি।
২০০৪ সালে যখন শিলিগুড়ির প্রধান নগরে গ্রিন পার্ক চালু হয় তখনও শহরে আবাসন তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি। মাটিগাড়ায় সবে একটি উপনগরী তৈরি হয়েছে। সেবক রোডে চেকপোস্টের কাছে সরকারি আবাসনের বুকিং চলছে। মূলত চাকরি সূত্রে শিলিগুড়িতে ঠাঁই নেওয়া কিছু মানুষ স্থায়ী ঠিকানার খোঁজে চলে আসেন এখানে। তার পরে নিজের বাড়ির মতোই ভালোবেসে ফেলেন আবাসনকে। ফলে ইট-কাঠ-কংক্রিটের বহুতল গ্রিন পার্ক সুখী গৃহকোণ হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। শিলিগুড়ির প্রধান নগরে পরে আরও আবাসন তৈরি হয়। কিন্তু গ্রিন পার্ক কোনওটা হয়ে উঠতে পারেনি। আবাসনে অবাঙালির সংখ্যাই বেশি। বাঙালি পরিবার মাত্র জন্য তিরিশ।
কিন্তু নানা ভাষাভাষির লোকেদের সমাহারই যেন গ্রিন পার্ককে প্রধান নগরের ভিতরে মিনি ভারতের রূপ দিয়েছে। শুরু থেকেই গ্রিন পার্কের বাসিন্দা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্টার তাপস চট্টোপাধ্যায়। শহরের অন্যতম শিক্ষাবিদ এবং রবীন্দ্র অনুরাগী। সমাজকর্মী। প্রাবন্ধিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবীর ১২৫ তম উদযাপন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সব ব্যস্ততাই ওই গ্রিন পার্ককে কেন্দ্র করে। ওই আবাসন এখন তাঁর ঘরবাড়ি। তাপসের কথায় '২০-২১ বছর এখানে হয়ে গেল। নিজের বাড়ির কথা ভুলেই গিয়েছি। এখন এটাই আমার কাছে সব।'
এই আবাসনের আর এক প্রবীণ মানুষ বিমল দেবনাথ। প্রাক্তন ডিএফও। পরিবেশপ্রেমী। লেখক। এবং পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে অক্লান্ত যোদ্ধা। তাঁর কথায়, 'শুরু থেকেই আমার পরিবার এখানে থাকেন। আমি বছর দুয়েক হলো অবসরের পরে বসবাস করছি। একটা আবাসনে সকলে মিলে একসঙ্গে থাকা দারুণ অভিজ্ঞতা।' গ্রিন পার্ক গোটা প্রধান নগরে পরিচিত বছরভর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য। দুর্গাপুজো থেকে রবীন্দ্র জয়ন্তী-সবেতেই গ্রিন পার্ক সকলের চেয়ে এগিয়ে। আবাসনের পার্কের মধ্যেই ছোট্ট বেদি তৈরি করা রয়েছে। দুর্গাপুজোয় ওখানে ম্যারাপ বাঁধা হয়।
আবার ২৬ জানুয়ারিতে ওখানেই তোলা হয় জাতীয় পতাকা। পুজোর কয়েকদিন রীতিমতো উৎসবের মেজাজ। একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া। প্রাণখুলে আড্ডা। বাড়ির মহিলারাও যেন ওই কয়েকটা দিন প্রাণ ভরে গল্প করতে পারেন। পার্কের পাশে আবাসন কমিটির নিজস্ব অফিস। সেখানে টেবল টেনিসের বোর্ড থেকে ক্যারম। খেলায় ছোট-বড় বলে কিছু নেই। যাঁর যখন ইচ্ছে, জুটি বেঁধে নেমে পড়লেই হলো। আবাসন কমিটি বেজায় খুশি পুরসভার ভূমিকায়। যে কোনও প্রয়োজনে পুরসভার সহায়তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। তাপস বলেন, 'একটা আবাসন পরিচালনা চাট্টিখানি কথা নয়। পুরসভার সাহায্য ছাড়া আবাসনকে বাসযোগ্য করে রাখাও সহজ নয়। তবে আমরা সেই সাহায্য চাইবার আগেই পেয়ে যাই।'