• সিবিআই চেয়ে নিহতের পরিবার কোর্টে, মমতার নিশানায় বিজেপি
    এই সময় | ০৬ মে ২০২৫
  • এই সময়: তিনি যখন রাজনীতি করেন কিংবা প্রশাসনিক প্রধানের চেয়ারে থাকেন, তখন তাঁর কাছে সব ধর্মই সমান এবং মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করেন না— সোমবার মুর্শিদাবাদ সফরে গিয়ে ফের সে কথা জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    পাশাপাশি নাম না–করে মুখ্যমন্ত্রী বিঁধলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও তাঁর দল বিজেপিকে। সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ ঘিরে কয়েক সপ্তাহ আগে অশান্তি ছড়িয়েছিল মুর্শিদাবাদের কয়েকটি প্রান্তে। নিহত হয়েছিলেন তিনজন। বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকবার মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, সুতি বা ধুলিয়ানে গিয়েছেন।

    আপাতত মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। ওই ঘটনার পরে এই প্রথমবার মুর্শিদাবাদ সফরে গেলেন মমতা। ঘটনাচক্রে তাঁর সফরের আগেই সামশেরগঞ্জের জাফরাবাদে নিহত বাবা–ছেলের পরিবারকে নিয়ে নতুন করে টানাপড়েন শুরু হয়েছে। নিহত হরগোবিন্দ দাসের পরিবারের কয়েকজন সদস্য হাইকোর্টে মামলা দায়ের করার জন্য ইতিমধ্যে কলকাতায় চলে এসেছেন।

    ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সিবিআই তদন্ত দাবি করে সোমবার বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের এজলাসের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা। মুর্শিদাবাদ সফরে গিয়েও তাঁদের সঙ্গে দেখা না–হওয়ায় আক্ষেপও জানান মুখ্যমন্ত্রী।

    এ দিন মমতা অভিযোগ করেন, বিজেপি ওই পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে দিয়েছে। এ দিন দুপুরে দাস পরিবারের সদস্যেরা হাইকোর্টে অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁদের আটক করতে চেয়েছিল। তাঁরা স্বেচ্ছায় কলকাতা চলে এসেছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি ওই পরিবারের সঙ্গে আন্তরিক ভাবেই দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপির প্ররোচনায় তা হলো না। জাফরাবাদে বাবা-ছেলে খুন হওয়ার পরে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তাঁদের পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে দেন।

    এ দিন সরাসরি সে প্রসঙ্গ উল্লেখ না–করে মমতা বলেন, ‘আমি ১০ লক্ষ টাকা করে (ক্ষতিপূরণ) পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে আসতাম। আপনারা (বিজেপি) তাঁদের লুকিয়ে নিয়ে গেলেন কেন? এখন তাঁদের দিয়ে আমাকে গালাগাল দেওয়াচ্ছেন। আপনারা অশান্তি করবেন, আর গালাগালি আমি শুনব?’ তাঁর সংযোজন, ‘বিজেপির বোঝা উচিত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যারা করে, তাদের আমরা ক্রিমিনাল বলি। তাদের আমরা কোনও ধর্ম-বর্ণ-জাতি হিসেবে বিচার করি না।’

    নিহতের ছোট ছেলে অবশ্য এ দিন কলকাতায় শুভেন্দু অধিকারীর পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি যেখানেই যাচ্ছিলাম, সেখানেই নিরাপত্তারক্ষী যাচ্ছিল, টয়লেটে গেলেও। আমাকে দিয়ে কিডন্যাপের কথা লেখানো হয়েছে। আমার মা হাইকোর্টে মামলা করার জন্য নিজেদের ইচ্ছায় কলকাতায় এসেছেন। আমাদের কেউ জোর করে কলকাতায় আনেনি। পুলিশ চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছিল। টাকা দেওয়ার কথা বলছিল। চাকরি দেওয়ার কথাও বলছিল। আমরা টাকা ‍নেব না, চাকরিও নেব না।’

    আর শুভেন্দুর কথায়, ‘তিনি বাম দল করতেন, নাকি লাল দল করতেন, নাকি সাদা দল করতেন, আমার দেখার দরকার নেই। সবার আগে হিন্দু। হিন্দু বিপদে পড়লে তাঁকে আকড়ে ধরা প্রকৃত হিন্দুর কাজ।’ এই প্রসঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘নিহতের পরিবারকে নিয়ে বিজেপি ও তৃণমূল টানাহ্যাঁচড়ায় নেমেছে। শেষকৃত্যের সময়ে এরা কেউ পাশে থাকেনি। এখন টাকার জোরে, ক্ষমতার জোরে এই টানাটানি করছে।’

    মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক অশান্তির পিছনে নাম না–করে শাহ ও তাঁর দলকে আক্রমণ শানিয়েছেন। বহরমপুরে তিনি এ দিন শাহকে দেশের ‘অ্যাক্টিং প্রাইম মিনিস্টার’ বলেও কটাক্ষ করেন। মমতার কথায়, ‘আমি কোনও সম্প্রদায়কে দোষ দেবো না। কিছু মানুষ ধর্মীয় নেতা সেজেছেন। ধর্মের নামে তাঁরা বিধর্মের কথা বলেন। পালে বাঘ না–পড়লেও বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করেন। তাঁরাই অশান্তি করেন। তাঁরা বাংলার শত্রু।’

    মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে মমতা বলেন, ‘এই জেলা একটা সময়ে বাংলার রাজধানী ছিল। এখানকার দুটো ওয়ার্ডে গোলমাল হয়েছে। কারা করিয়েছে, কী ভাবে করিয়েছে, আমি ক্রস-চেক করছি। পুরো তথ্য পেয়ে গেলে আমি তা প্রকাশ করব।’ তাঁর সংযোজন, ‘আমি যখন রাজনীতি করি বা কোনও চেয়ারে থাকি, আমার কাছে সব ধর্ম সমান, সকলে সমান। আমি চাই না, বাংলায় কোনও সম্প্রদায় আক্রান্ত হোক। মুর্শিদাবাদে তো চক্রান্ত করে অশান্তি হয়েছে।’

    এর পরেই মমতা অভিযোগ করেন, বিএসএফ গুলি না–চালালে ধুলিয়ানে এত অশান্তি হতো না। তাঁর কথায়, ‘যাঁরা নিকটজনকে হারিয়েছেন, তাঁদের বিচার দিন। আমি সাংসদ হিসেবে ১০-১২ জন প্রধানমন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখেছি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে (নরেন্দ্র মোদী) কিছু বলছি না। আমি অ্যাক্টিং প্রাইম মিনিস্টারকে নিয়ে বলছি।’ তার পরেই সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে মমতা বলেন, ‘এখন দেশের অ্যাক্টিং প্রাইম মিনিস্টার কে? আমাকে কয়েকদিন আগে কিছু ছাত্র এই কথা জিজ্ঞেস করেছিল।’

    জবাবে তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি তো জানি না!’ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ আপনি চেয়ারে আছেন, ততক্ষণ আপনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করতে পারেন না।’ প্রসঙ্গত এর আগে নেতাজি ইন্ডোরের সভাতেও শাহ-কে আক্রমণ করেছিলেন তিনি।

    মুখ্যমন্ত্রী এ দিন কেন্দ্রীয় সংস্থাকেও নিশানা করেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনা যে দিন হলো, তার পরের দিনই মানবাধিকার কমিশন চলে এল! কই মণিপুরে তো যায়নি! উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি, বিহারে তো যায়নি! এখানে উস্কানি দেওয়া হয়েছে। বাংলা এটা সহ্য করবে না।’ নাম না–করে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের এক সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধেও উস্কানির অভিযোগ করেন।

    তিনি বলেন, ‘এখানে অন্য সংগঠন আছে। তার নেতা আছেন। তিনি উস্কানি দেন। অশান্তির সময়ে ৪৮ ঘণ্টা তিনি আলো নিভিয়ে রেখেছিলেন। এটা করা যায় না। কী লুকোতে চেয়েছিলেন?’ এর পরেই তিনি বলেন, ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের দিলীপ মহারাজকে আমি শ্রদ্ধা করি। তিনি সব অনুষ্ঠানে আসেন। আমি যখন গঙ্গাসাগর যাই, সেখানকার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ আমাদের খুব সাহায্য করে। কিন্তু এখানকার ব্যাপারটা একটু আলাদা।’

  • Link to this news (এই সময়)